মীর মোশাররফ হোসেন: সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ২৬ স্বদেশীর ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা’ নিয়ে বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি উদ্বেগও প্রকাশ করছেন দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিরা।
তারা বলছেন, দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা নিয়ে তারা চিন্তিত থাকলেও প্রবাসে বসে বাংলাদেশিরা এই কাজ করবে, তা ভাবতে পারেননি।
“সিঙ্গাপুর খুবই নিরাপদ এবং আমরা একে এরকমই দেখতে চাই। আশা করব, সিঙ্গাপুরবাসী আমাদের সবাইকে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখবে না,” এক ধরনের শঙ্কা নিয়েই বলছেন প্রবাসী নির্মাণ শ্রমিক মো. নুরুজ্জামান (৩২)।
আইএসকে অনুসরণ করে ওই ২৬ জনের বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকারী সিঙ্গাপুরের দৈনিক স্ট্রেইট টাইমসকে একথা বলেন তিনি।
‘লিটল ইন্ডিয়ায়’ থাকা অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের আশঙ্কা, এই ঘটনা সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাকরির বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
নুরুজ্জামান বলেন, “এরা খুবই অল্প। এখানে থাকা প্রবাসীদের তুলনায় তারা নগন্য। আমাদের অধিকাংশ-ই তাদের বিশ্বাসের সাথে একমত নয়। আমাদের দেশও জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী নয়।”
পারভেজ রহমান (৪৪) নামে অন্য এক নির্মাণ শ্রমিক চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে বলেন, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসীদের অবশ্যই সিঙ্গাপুরে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।
“এটা আমার পরিবার কিংবা দেশের জন্য নিরাপদ নয়। এরা বিপজ্জনক।”
নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ভবিষ্যতে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট এরকম কারও খোঁজ পেলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষের হাতে সোপর্দ করবেন বলে জানান ছয় বছর ধরে সিঙ্গাপুরে থাকা এই বাংলাদেশি।
এ ঘটনায় ‘বিরক্তি’র কথা জানিয়েছেন প্রবাসী শ্রমিক সুশীর রায়ও। তিনি বলেন, বাংলাদেশি প্রবাসীরা এখানে কাজ করতে এসেছে, সমস্যা সৃষ্টি করতে না।
“এটা খুবই বেদনাদায়ক। যেখানে সারাক্ষণ আমরা কী করে আমাদের দেশের উন্নতি হবে, তা নিয়ে চিন্তা করি, সেখানে কিছু লোক চিন্তা করছে কী করে ধ্বংস করা যায়!”
মাসুদ (২৪) নামে আরেক বাংলাদেশি শ্রমিকও সুশীরের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
“এটা ঘটবে আমি কল্পনাও করিনি। একজন বাংলাদেশি ও একজন মুসলমান হিসেবে আমি লজ্জিত।”
নির্মাণ শ্রমিকের কাজে থাকা ওই ২৬ জনকে গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। কাজের অনুমতি বাতিল করে এদের সবাইকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
বুধবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ওই ২৬ জনসহ মোট ২৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। পালানোর চেষ্টা করা অন্য শ্রমিককে সাজা শেষে ফেরত পাঠানো হবে বলে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
এ ২৭ জন সিঙ্গাপুরে বসে বাংলাদেশের ‘সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের’ পরিকল্পনা করছিল বলে চ্যানেল নিউজ এশিয়ার এক খবরে বলা হয়।
এ ঘটনাকে ‘খুবই লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করে মালয়েশিয়ার বাংলা সংবাদপত্র ‘বাংলার কণ্ঠ’-র সম্পাদক আবুল খায়ের মহসিন বলেন, “তারা এখানে কাজ করতে এসেছে, রাজনীতি বা জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে নয়।”
মহসিন স্ট্রেইট টাইমসকে বলেন, গত বছরের নভেম্বরে এক শ্রমিক তাকে অন্য একজনের নিখোঁজের কথা জানালে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, ওই শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুধবারের প্রকাশিত তালিকায়ও নিখোঁজ ওই শ্রমিকের নাম আছে বলে জানান মহসিন।
পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর জন্য আদালতে তোলা হলে ২৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো বিষয়টি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসে। তবে ঠিক কী কারণে কবে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে তা বুধবার সিঙ্গাপুর সরকারের বিবৃতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্পষ্ট ছিল না।
ওই ১৪ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের মোস্তফা নামের একটি মার্কেটের কাছে এক মসজিদে সপ্তাহে একদিন তারা একত্রিত হতেন এবং বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করতেন। সেখানে জিহাদি বক্তব্য প্রচার করে এবং ভিডিও দেখিয়ে অন্যদের জঙ্গি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতেন তারা।
সিঙ্গাপুর সরকার বলছে, এই বাংলাদেশিরা নিজেদের মধ্যে জিহাদি বই ও ভিডিওসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বিনিময় করতেন এবং দল বাড়াতে সতর্কতার সঙ্গে অন্য বাংলাদেশিদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন।
“এদের মধ্যে কয়েকজন ধর্মের নামে সশস্ত্র জিহাদ সমর্থন করার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। কয়েকজন বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জিহাদে যোগ দেওয়ার কথাও তারা ভেবেছিলেন। আর কয়েকজন বলেছেন, বিভিন্ন স্থানে শিয়া মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নৃশংস হামলার ঘটনা তারা সমর্থন করেন, কারণ শিয়ারা ভিন্ন মতাবলম্বী।”
রোববারই শুধু মসজিদে যেত আকরাম:
ফেরত পাঠানো ২৬ প্রবাসী শ্রমিকের গোপন কর্মকাণ্ড বিস্মিত করেছে সিঙ্গাপুরে থাকা তাদের বন্ধুবান্ধবদেরও।
এদেরই একজন বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক মাহবুব।
ছয় বছর আগে ঝিনাইদহের একই গ্রামের বন্ধু মো. আকরাম হোসেনের (২৭) সঙ্গেই সিঙ্গাপুরে আসেন এ শ্রমিক। বুধবার সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের বিবৃতির পর তিনি জানতে পারেন বন্ধুর ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা’।
মাহবুব স্ট্রেইট টাইমসকে বলেন, গত বছরের নভেম্বরের এক সকালে প্রথম আকরামের ছোট ভাই তাকে ‘আকরামের নিখোঁজের’ কথা জানান।
“আমি ওর কথার বেশিরভাগই বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু সে যে আতঙ্কিত তা টের পাচ্ছিলাম।”
আকরামকে দেস্কের রোডের দোকান থেকে কয়েকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আকরাম ওই দোকানেই থাকতেন। এরপর থেকেই তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
“আমি এরপর আকরামকে ফোন দিই, কিন্তু সে ধরে না,” বলেন মাহবুব।
সপ্তাহখানেক পরেও কোন খোঁজ না পাওয়ায় আকরামের ভাই ‘চিন্তিত হয়ে পড়লে’ মাহবুব থানায় যান। থানা কর্তৃপক্ষ মাহবুবকে আকরাম যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তার প্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
“আকরামের প্রতিষ্ঠানের মালিক আমাকে জানান, তাকে সিঙ্গাপুরের পুলিশ গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে,” বলেন মাহবুব।
মাহবুব এ কথা আকরামের ছোট ভাইকে জানালে সে নিশ্চিন্ত হয়। পরের মাসে মাহবুব আবার জানতে পারেন, বাংলাদেশে নামার সঙ্গে সঙ্গে আকরামকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ ঘটনায় কিছুটা চিন্তিত হলেও মাহবুব বুধবার দেওয়া সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের বিবৃতির পর ‘পুরোপুরি হতভম্ব’ হয়ে পড়েন।
“ও তো শুধু রোববারেই মসজিদে যেত। এর মধ্যেই যে সে উগ্রবাদী ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে, তা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাইনি।”
আকরামকে দেখে কোনোভাবেই সেরকম মনে হয়নি বলে জানান এ প্রবাসী শ্রমিক।
২৭ শ্রমিকের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় প্রবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করলেও সিঙ্গাপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানিয়েছেন, কয়েকজন ‘সন্ত্রাসী’র দায় পুরো কমিউনিটির উপর দেওয়া হবে না।
তাদের ভাষ্য, সন্দেহ নয়, বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের দিকে কোম্পানিগুলো নজর দিলে সিঙ্গাপুরকে ‘আরও নিরাপদ’ করা যাবে।
“নির্মাণ কাজে ভারত ও বাংলাদেশের শ্রমিকদের এখনও চাহিদা আছে। কারণ তাদের মতো পরিশ্রমী শ্রমিক পাওয়া যায় না,” সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমসকে বলেন নির্মাণ কোম্পানি জিয়ান হুয়াং এর মহাপরিচালক এনি জেন।
তিনি জানান, কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নজর দিলে এ ধরনের ঘটনা এমনিতেই কমে আসবে।
“একটা ঘটনা দিয়ে আমরা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনা বন্ধ করতে পারি না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কোম্পানিগুলো যেন তাদের শ্রমিকদের কল্যাণে আরও বেশি মনোযোগী হয়। শ্রমিক যেন নিজেকে কোম্পানি ও সিঙ্গাপুরের অংশ মনে করে।”
কেবল নির্মাণ খাতই নয়, বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশটির ‘ক্লিনিং সেক্টরে’ও কাজ করে থাকেন। সেখানেও তাদের চাহিদা ‘সহজে বন্ধ হবে না’ বলে জানান রামকি ক্লিনটেক সার্ভিসের পরিচালক মিল্টন এনজি।
সিঙ্গাপুরে বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি আছেন বলে জানিয়েছেন দেশটিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মাহবুব-উজ-জামান।
স্বল্প বেতনের বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা এখানে সব সময়ই বেশি বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
“২০১৫-র জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি এসেছেন, যা আসলে বাংলাদেশিদের জন্য নির্ধারিত কোটার চাইতেও অনেক বেশি।
“এটি সম্ভব হয়েছে কারণ স্বল্প বেতনের চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা এখানে খুব বেশি। বিশেষ করে এখানকার জাহাজ ও নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে সব সময়।”-বিডি নিউজ
২২ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/জেএম/আরএম