সোমবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৬:৩৪:৫৩

জীবন সংগ্রামে জয়ী তাঁতি সালেহা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

জীবন সংগ্রামে জয়ী তাঁতি সালেহা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

নিউজ ডেস্ক : একটি হস্তচালিত তাঁতকল থেকে ৪৬টি যন্ত্রচালিত তাঁত কলের মালিক হয়েছেন সালেহা বেগম। গড়ে তুলেছেন পারুল টেক্সটাইল নামে একটি তাঁত কারখানা। নারী-পুরুষ মিলে ২৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে তার তাঁত কারখানায়।

অভাবের সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। বর্তমানে সালেহা বেগমের কারখানায় প্রতি সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫ হাজার গজ কাপড় উৎপাদন হয়। উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করে প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখ টাকার ওপর মুনাফা হয়। সালেহা বেগমের কারখানার উৎপাদিত কাপড় যাচ্ছে রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

সব মিলিয়ে সালেহা বেগম আজ জীবন সংগ্রামে জয়ী একজন সফল নারী।ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী জেলার মাধবদী ইউনিয়নের মহিষাটি গ্রামের অধিবাসীরা ২০০১ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সহযোগিতায় একতা নামে একটি গণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। গণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ।

সালেহা বেগম নামে ওই এলাকার একজন দরিদ্র গৃহবধূ প্রতিবেশীদের পরামর্শে গণকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। গণকেন্দ্রের বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে এবং অন্যদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে তার দৃষ্টি খুলে যায়।

সংসারের অভাব-অনটনের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করে জীবনে উন্নতির চিন্তা মাথায় আসে তার। তখন থেকেই সালেহা স্বপ্ন দেখেন নিজে একটি তাঁত কারখানা গড়ে তোলার। কিন্তু তার হাতে তখন কোনো পুঁজি ছিল না। পুঁজি না থাকলেও থেমে যাননি সালেহা বেগম।

তাঁতকল কেনার স্বপ্ন মাথায় নিয়ে ২০০২ সালে মহিষাটি গ্রামের একতা মহিলা উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে সালেহা বেগম ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে একটি হস্তচালিত তাঁত ক্রয় করে বস্ত্র উৎপাদন শুরু করেন। তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের কাজে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে শ্রম দিতে থাকেন। তাঁতের সাদা কাপড় প্রসেসিংপূর্বক বিভিন্ন রকম বেডশিট, লালশালু, শাড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়।

ধীরে ধীরে আসতে থাকে সফলতা।এ অবস্থায় সংস্থার ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে অসুবিধা হয় না।তার উত্তরোত্তর অগ্রগতি দেখে সংস্থা তাকে ক্ষুদ্রঋণী থেকে ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করে এবং ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা হিসেবে ঋণ প্রদান করে।মুনাফার টাকায় সালেহা বেগম প্রতিবছর বাড়াতে থাকেন তাঁতের সংখ্যা।

সালেহার স্বামী গাফফার জানান, কারখানার অর্জিত মুনাফা থেকে সালেহা বেগম এ যাবৎ ৩৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন, ৪৬টি যন্ত্রচালিত তাঁত নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি তাঁত কারখানা। সালেহা বেগমের এ কারখানায় ২৬ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে সালেহা বেগমের সংসারে একটি সচ্ছল সংসারে যা কিছু থাকা দরকার তার সবই আছে।ছেলেমেয়েরা করছে লেখাপড়া।পাশাপাশি তার কারখানায় যারা কাজ করছে তাদের সন্তানদের লেখাপড়াতে দিচ্ছে উৎসাহ।

সালেহা বেগম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই ধরনের উদ্যোগ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিস্তৃত হলে তার মতো আরও অনেকের দারিদ্র্য দূর হবে।সালেহা বেগমের স্বামী আরও জানান, বিদ্যুৎ ও সুতার দাম বাড়ায় আগের মতো লাভ হয় না। বর্তমানে তাদের কারখানায় ৪৬টি যন্ত্রচালিত তাঁতকলের মধ্যে ১৬টি চালু আছে।তবে বড় ধরনের ঋণ পেলে তাদের কারখানাটি আরও বড় করার আশা রয়েছে।

সালেহা বেগমের এ সফলতা একদিনে আসেনি।প্রথম দিকে বেশ হোঁচট খেতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে অনেক সমালোচনা।তবে সালেহা বেগম অর্থনৈতিক উন্নতি এবং মিশনকর্মীদের উৎসাহ এবং সহযোগিতার কারণে হাল ছাড়েননি।

আস্তে আস্তে সব বাধা দূর হয়ে সালেহা বেগমের ব্যবসায় বাড়তে থাকে আয়। সালেহা বেগমের এ সফলতায় স্বামী এবং পরিবারের লোকজন বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত।এভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে যায় সালেহা বেগম। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ক্রয় করেন নতুন যন্ত্রচালিত তাঁত, নিয়োগ দেন কর্মচারী।

জানা যায়, নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী ইউনিয়নের মহিষাটি গ্রামে সালেহা বেগমের জন্ম। দরিদ্র তাঁতি পিতার অভাবের সংসারে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। ১৬ বছর বয়সে একই গ্রামের বিবাহিত দিনমজুর গাফফার মিয়ার সঙ্গে সালেহার বিয়ে হয়। সতিনের সংসারে অভাব-অনটনের মাঝেই পাঁচ বছরে তিন সন্তানের মা হন সালেহা বেগম। স্বামীর একার উপার্জনে সাত সদস্যের দুই সংসারে অভাব আর অশান্তি ছিল প্রতিদিনের সাথী।

সন্তানদের বাড়তি খরচ জোগাতে এরই মধ্যে সংসারের টানাপড়েন বেড়ে যায়। অভাবের তাড়নায় সালেহা বেগম অন্যের তাঁত কারখানায় কারিগর হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজের ভাগ্য বদলানোর আশায় সালেহা বেগম ২০০২ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে একটি হস্তচালিত তাঁত ক্রয় করে বস্ত্র উৎপাদন শুরু করেন। তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

সালেহা বেগমের এ সফলতায় পরিবারের সদস্যরা তার বুদ্ধি এবং মতামতকে দিচ্ছে প্রাধান্য। সালেহা বেগমের দক্ষতা এবং যোগ্যতা বর্তমানে পরিবার ও সমাজে স্বীকৃত। সালেহা বেগম আজ শুধু নারী নয় একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মনোবল ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে শত বাধা অতিক্রম করে কীভাবে জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নরসিংদীর মাধবদী ইউনিয়নের মহিষাটি গ্রামের সালেহা বেগম।
২৫ জানুয়ারি ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে