মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:০১:১৯

শীতের দাপটে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা

শীতের দাপটে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা

ঢাকা : বৃষ্টি সঙ্গে করেই সারা দেশে মাঘের শীত জেঁকে বসেছে। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে, যা আরো তিন-চার দিন চলতে থাকবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকবে। গতকাল সোমবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গোপালগঞ্জে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন রবিবার চুয়াডাঙ্গায় ছিল সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ১ ডিগ্রি।

শীতের দাপটে শিশু ও বয়স্কদের রোগবালাই বাড়ছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জেলায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক শ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে অন্তত আট শিশু। গতকাল দেশের অন্তত ১৫ জেলা থেকে পাঠানো খবরে দেখা গেছে, মাঘের

কনকনে শীতের সঙ্গে কুয়াশার কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। শীতবস্ত্রের কারণে কষ্ট পাচ্ছে দরিদ্র মানুষজন। সরকারি সহায়তা সেই তুলনায় অপ্রতুল।

আবহাওয়া দপ্তর বলছে, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ রয়েছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শৈত্যপ্রবাহ চলছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘বলা যায়, শীতের প্রকোপ শেষ হয়ে আসছে। এরপর আর শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস নেই।’

গোপালগঞ্জ কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, বর্তমানে গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ চলছে। আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত এ শৈত্যপ্রবাহ বিদ্যমান থাকবে। এ কারণে মঙ্গলবারের তাপমাত্রা রেকর্ডকৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রার কাছাকাছি থাকতে পারে। তবে, দিনের বেলায় আকাশে রোদ থাকায় আবহাওয়া উষ্ণ থাকবে। বাতাসের সঙ্গে কনকনে শীতও থাকবে।

শীতজনিত রোগ : চুয়াডাঙ্গা সিনেমা হলপাড়ার গৃহিণী সাজেদা ইসলামের পরিবারের লোকসংখ্যা চারজন। বাড়ির সবাই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত। কাশি ও গলাব্যথা দেখা দিয়েছে। এই পরিবারের চারজনই বাড়িতে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাচ্ছে।

সাতটি জেলার হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ শতাধিক শিশু শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার সমস্যা নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে। সেই সঙ্গে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বয়স্করাও।

গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল ৫৯ শিশু রোগী। আর মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল ২০ জন বয়স্ক রোগী। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ৫০০ শিশু ভর্তি আছে, যাদের মধ্যে অনেকেই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত। গত এক সপ্তাহে এখানে পাঁচ-সাতটি শিশু এ ধরনের রোগে মারা গেছে। প্রতিদিন গড়ে দিনাজপুরের জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে ৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে।

এদের মধ্যে জেলা সদরের গাবুরা গ্রামের নাজমুল হকের ১৮ মাসের শিশু ছেলে আজিম নিউমোনিয়ায় মারা গেছে গত শনিবার। গতকাল নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৬৪ শিশু। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে ২০০ শিশু চিকিৎসা নিতে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ভিড় করছে। শিশু ওয়ার্ডগুলোতেও ভর্তি আছে প্রায় আড়াই শ শিশু। জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে গত তিন দিনে ৩০ রোগী ভর্তি হলেও চিকিৎসা নিয়েছে ৪০ জনেরও বেশি। বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫০টির বেশি শিশু এবং ২০ জন বৃদ্ধ ভর্তি হয়েছেন।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শারমিন পারভীন বলেন, শিশুদের গরম কাপড় পরিধান করা এবং তাদের ঘরের বাইরে সকালে এবং সন্ধ্যার পর বের না করাই ভালো।

শীতে কাহিল জনজীবন : শীতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। ছিন্নমূল, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা ও গোপালগঞ্জে জনজীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামের রিকশাচালক মজিবর রহমান বলেন, ‘আমি আজকে (সোমবার) সকাল ৬টায় রিকশা নিয়ে বাইরে এসে দেকি কুনু নোক ( কোন মানুষ) নেই। একেনে আগুন ধরিয়ে চুপ করি বইসলাম। সকাল ১০টা নাগাত একটা ভাড়া মারলাম। জারের (শীতের) জন্যি নোকজন বাইরি আসে না।’

উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে সন্ধ্যার পর পরই চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ১০ হাত দূরের কোনো কিছু দেখা যায় না। ঘন কুয়াশার কারণে দিনের বেলায়ও রাস্তায় যানবাহন চালাতে হচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। আর রাতের বেলায় ঝির ঝির করে কুয়াশা ঝরছে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে খুব একটা বের হচ্ছে না। একটানা তিন দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।

সদর উপজেলার ভাঁদগাঁও গ্রামের দিনমজুর ভুলেশ বর্মণ বলেন, ‘প্রতিদিন শহরে আসচু কাজ মিলচে নি। মোর বাড়িত খাউনে ওয়ালা পাঁচজন। মোর বউও মানুষের বাসায় কামলা খাটে খাবার নিয়ে আসে সেলায় খাচি তিন দিন ধরে।’

গাইবান্ধায় রবিবার সারা রাত ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির মতো শিশির পড়েছে। এ ছাড়া গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত হিমেল হাওয়া ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়েছিল সর্বত্র। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী পথে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের গ্রামগুলোর সঙ্গে জেলা ও উপজেলা সদরের নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় চরাঞ্চলের মানুষদের চরম বিপাকে পড়তে হয়।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ আলী জানান, গতকাল রংপুর অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তিস্তাপারের ধামুর এলাকার এরশাদ আলী (৭০) বলেন, ‘নদীপারের ঝুপড়ি ঘরোত হু হু করি বাতাস ঢোকে। ঠাণ্ডায় সারা রাইত নিন (ঘুম) ধরে না।’ একই এলাকার শহর বানু ও জাহানারা বেগম বলেন, ‘মাঘের জারে (মাঘ মাসের ঠাণ্ডায়) বাঘ কান্দে সবায় কয়, তয় এবার মাইনসের কান্দন কাইও দ্যাকে না।’

শেরপুর জেলা সদর ও নকলা উপজেলার চরাঞ্চল এবং নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদের ছিন্নমূল-দরিদ্র মানুষের কষ্টের শেষ নেই। যশোরে দুপুর ১২টার আগে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছিন্নমূল ও গরিব মানুষ শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাস্তার পাশে আগুন জ্বেলে বসে থাকছে।

সরকারি সহায়তা অপ্রতুল : ঠাণ্ডায় শ্রমজীবী, ছিন্নমূল মানুষের অবস্থা বেশি কাহিল। শীতবস্ত্রের অভাবে কাজের জন্য বাইরেও বের হতে পারছে না তারা। কেউ কেউ পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে শীতবস্ত্র কিনছে। সরকারি সহায়তা অপ্রতুল বলে জানা গেছে। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর কম্বল বিতরণ করেছে।

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, জেলার পাঁচটি উপজেলায় সরকারিভাবে ২১ হাজার ২৪২টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গাইবান্ধা সদরে আট হাজারসহ ৩১ হাজার কম্বল সাত উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে। পিরোজপুর উপজেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, মহিলা পরিষদ, মহিলা সংস্থা, অ্যাপেক্স ক্লাব, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে।

নীলফামারী সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন এবং এক পৌরসভায় এবার পাঁচ হাজার ৪৮০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। আর জেলায় এ পর্যন্ত ২৪ হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। শেরপুরে জেলা আইনজীবী সমিতির কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সমিতির কার্যালয়ের সামনে দেড় শতাধিক শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা ও দায়রা জজ মো. মোজাম্মেল হক।

ফসল ও আবাদ নিয়ে শঙ্কা : নীলফামারীর পৌর এলাকার দক্ষিণ হাড়োয়া গ্রামের কৃষক হিরম্ব কুমার রায় (৫৫) প্রতিবছর বেরো আবাদ করেন পাঁচ বিঘা জমিতে। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে শীতের কারণে জমিতে কাজ করাচ্ছি না। ঠাণ্ডায় শ্রমিকরা কম কাজ করতে পারে।’ অন্যান্য বছর এ সময়ে বোরো আবাদের জমিতে চারা রোপণের কাজ শেষ করলেও এবার শীত কমার অপেক্ষায় বন্ধ রেখেছেন বলে তিনি জানান।

দিনাজপুরে চলতি মৌসুমে পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কুয়াশার প্রভাবে বোরো চারা নষ্টের আশঙ্কায় লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫ শতাংশ জমিতে রোপণ করা সম্ভব হয়ছে। কুয়াশা, মেঘলা আকাশসহ হালকা বৃষ্টিতে নাভি ধস রোগে ফসলের ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কা কৃষি কর্মকর্তাদের।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে না আসা পর্যন্ত কৃষকদের বোরো চারা তোলা এবং রোপণ না করতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। তবে গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক সমীর কুমার গোস্বামী জানিয়েছেন, রাতে আবহাওয়া কমে গেলেও দিনের বেলায় রোদ থাকায় ওই জেলায় ফসলের ওপর প্রভাব পড়বে না।

কুয়াশায় ফেরি চলাচলে বিঘ্ন : ঘন কুয়াশার কারণে গতকাল ভোর সাড়ে ৫টা থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে সব ধরনের ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এর আগে পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান মাঝ নদীতে আটকে পড়ে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আবার ফেরি চলাচল শুরু হয়। এ কারণে পণ্যবোঝাই প্রায় তিন শতাধিক ট্রাক আটকা পড়ে।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় শিমুলিয়া ঘাট থেকে শরীয়তপুরের কাওড়াকান্দি পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সকাল সাড়ে ৯টায় সচল হয়। ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ফেরি বন্ধ ছিল। সে কারণে দুই ঘাটে শতাধিক যানবাহন আটকা পড়ে। তবে দুপুরের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।

মহাসড়কে যানজট : ঘন কুয়াশা ও সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গজারিয়া অংশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। রবিবার মধ্যরাত থেকে সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গজারিয়া অংশের আনারপুরা ও ভাটেরচর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা এবং মেঘনা সেতুর ওপর যানবাহন বিকল হওয়া ও ঘন কুয়াশার কারণে মধ্য রাত থেকে মহাসড়কের উভয় দিকে প্রায় ২০ কিলিমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। -কালের কণ্ঠ

২৬ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে