শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৩৫:৪৬

নতুন চমক ও পরিবর্তনের ঝড় দুই দলেই

নতুন চমক ও পরিবর্তনের ঝড় দুই দলেই

আবদুল্লাহ আল মামুন/হাবিবুর রহমান খান ও নজরুল ইসলাম : জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই শিবিরেই পরিবর্তনের ঝড় উঠেছে। আগামী ২৮ মার্চ ক্ষমতাসীনদের এবং ১৯ মার্চ মাঠের বিরোধী দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ কাউন্সিল ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন দু’দলের সব স্তরের নেতাকর্মীরা।

পাশাপাশি বর্তমান পদ হারানোর আতংকে আছেন দল দুটির অনেক প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডিয়াম ও সম্পাদকমণ্ডলী থেকে ছিটকে পড়তে পারেন বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ ও নিষ্ক্রিয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা। পাশাপাশি একই দৃশ্য বিএনপিতেও। সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেসব নেতা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদের অধিকাংশই জাতীয় স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন।

প্রভাবশালী অনেকেই বাদ পড়ছেন : মন্ত্রিসভার মতোই মার্চে অনুষ্ঠেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বড় ধরনের চমক আসছে। গঠনতন্ত্র সংশোধন ও কমিটির কলেবর বৃদ্ধির পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় কাউন্সিলে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে শাসক দলটির অনেক প্রভাবশালী নেতার। এসব নেতাকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ থেকে বাদ দেয়া হবে।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে যেভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, ঠিক সেভাবেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ ও নিষ্ক্রিয়দের বিদায় দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

বিগত মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ডা. দীপু মনি, ড. আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, ড. হাছান মাহমুদ ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। পরে প্রভাবশালীদের এ তালিকায় যুক্ত হন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এলে এই ৬ জনই বিদায় নেন, যা ছিল তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। এদের একজন মন্ত্রিত্ব হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তারা গত দুই বছর ধরেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এদের কেউ কেউ এবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদও হারাতে পারেন। যদিও ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সর্বশেষ ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলেই প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ খুইয়েছেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্যের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ ইস্যুতে ওই নেতার কর্মকাণ্ডে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট। আরেকজন ঢাকার বাইরের প্রেসিডিয়াম সদস্যের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিব্রত দলের হাইকমান্ড। উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা শহরে তিনি নিজের ব্যক্তিগত অফিসে সাইনবোর্ডে ‘আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্যের কার্যালয়’ লিখে তদবিরসহ নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। তাই এ দুই নেতার বিদায় সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাধারণ সম্পাদক পদে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম টানা তৃতীয় দফা দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে জানা গেছে।

তবে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকদের ভাগ্য অনেকটাই তার ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের বেশির ভাগই বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। এই বিতর্কিতদের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। তৃণমূল নেতাদের অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ ও পৌর নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। মার্চে অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলে দু-একজন ছাড়া বাকিদের ভাগ্য বিপর্যয় হতে পারে। তারা এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানা গেছে।

দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা ও দমনের জন্য চরম সমালোচিত আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক, সাবেক বাম নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তাকে দফতর থেকে সরিয়ে ড. আবদুস সোবহান গোলাপকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। তারপরও আবদুল মান্নান খান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গিয়ে হাজির হন। এবার আবদুল মান্নান খানের বিদায় অনেকটাই নিশ্চিত বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্যগত কারণে ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর বিদায় প্রায় চূড়ান্ত। তিনি এখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় থাকায় যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুলের ওপর সন্তুষ্ট নয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। পরে অন্তর্ভুক্ত বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সাত্তারও এ কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন বলে আশংকা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, এবার আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে এক ঝাঁক তরুণের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহীমের বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ড খুবই ইতিবাচক বলে জানা গেছে।

এর বাইরে সহযোগী সংগঠন এবং পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, অথচ দলীয় কোনো পদে নেই- এমন নেতারা এবার আলোচনায় রয়েছেন।

নীতিনির্ধারণী ফোরাম আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজনের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যপদ হারাতে পারেন অনেক নেতাই।
এক ব্যক্তির একাধিক পদ আর নয়

বিএনপিতে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের জাতীয় স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটিতে দেখা যাবে নতুন মুখ। অতীতের মতো এবার একই ব্যক্তি একাধিক পদ দখলে রাখার কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি ভবিষ্যতে যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী তাদেরও জেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ না নিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

চেয়ারপারসনের নয়, এবার উপদেষ্টা পরিষদ হবে বিএনপির। এ ব্যাপারে দলের গঠনতন্ত্রে আনা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংশোধনী। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দলের সঠিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। পাশাপাশি নেতাকর্মীরাও সক্রিয় হতে আগ্রহ দেখাবেন বলে মনে করছেন সব পর্যায়ের নেতাকর্মী।

এদিকে আগামী ১৯ মার্চ কাউন্সিলের জন্য তিন স্থানে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। কাউন্সিলের সম্ভাব্য দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর নয়াপল্টন ও খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। গতি এসেছে তৃণমূল পুনর্গঠনেও। ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে আরও ২৪ জেলা কমিটি পুনর্গঠন করার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতীতের মতো লবিং আর তদবির করে এবার গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। দলের প্রতি অনুগত, বিগত আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে- এমন নেতাদের এবার গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হবে তরুণদের।

নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে কারা আসছেন সেই ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের কাছে দুর্নীতিবাজ বলে ধারণা রয়েছে এমন নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে না আনতে তারা পরোক্ষভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অবস্থান এবং পরবর্তী মহাসচিব কে হচ্ছেন সেদিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।
দলের হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানের কারণে বিগত আন্দোলন ও দলীয় কর্মসূচিতে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাঙ্গাভাব। অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় এবং সুবিধাবাদীরা রয়েছেন বাদপড়া আতংকে।

দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর পদ রক্ষায় তাদের অনেকে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। পদোন্নতি দূরে থাক, বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতেই মরিয়া তারা। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর সম্প্রতি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মহানগর নেতা আবদুস সালামসহ অনেকেই। বিগত সময়ে যাদের দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই এবারের কমিটিতে স্থান পেতে পারেন। তাদের অনেকে চেয়ারপারসনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগও রাখছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর দলের কাউন্সিল হতে যাচ্ছে। স্বভাবতই নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাঙ্গাভাব। পদ পেতে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিগত দিনে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তাদেরই নতুন কমিটিতে গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশেষ করে তরুণদের আমরা প্রাধান্য দিতে চাই। নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীদের পুরোপুরি বাদ দেয়া না হলেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন এমনটা নিশ্চিত।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন দলের চেয়ারপারসন। নেতৃত্ব বিকাশে এবার এক নেতারা এক পদ এ বিধানটি গঠনতন্ত্রে রাখার পক্ষে দলের অধিকাংশ নেতা। চেয়ারপারসনেরও এতে মৌন সম্মতি রয়েছে।

তিনি বলেন, দলে নতুন মুখ আসাটা স্বাভাবিক। কারণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা মারা গেছেন। আবার অসুস্থতার কারণে কেউ কেউ কাজ করতে পারছেন না। দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে এবং বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলেন তাদেরই নতুন কমিটিতে দেখা যাবে। নিষ্ক্রিয়তার কারণে কেউ বাদ গেলে তাতে দোষের কিছু নেই। তবে আমরা চাই সবাই দলের পক্ষে কাজ করুক।

কূটনীতিকদের নজর : নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরাও নজর রাখছে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের দিকে। আসন্ন কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন তা জানার চেষ্টা করছেন তারা। বিশেষ করে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রই এ ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেন। পৌনে এক ঘণ্টার নির্ধারিত সাক্ষাৎ প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী হয়। এ নিয়ে দল এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা গুঞ্জন ওঠে।

তাদের মধ্যে এত সময় কি আলোচনা হল। বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, দেড় ঘণ্টার বৈঠকে প্রায় ৪০ মিনিট খালেদা জিয়া ও বার্নিকাটের মধ্যে একান্তে আলাপ হয়। একান্ত আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে এখনও দলের নেতাদের সঙ্গে শেয়ার করেননি খালেদা জিয়া। তবে ওই সূত্রটি দাবি করেন, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভাবনা, দল পুনর্গঠনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের আগ্রহ আছে বলে মনে হয়। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজখবর নেন বার্নিকাট।

স্থায়ী কমিটি, মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদে আলোচনায় যারা : পঞ্চম কাউন্সিলের পর দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পান প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি মারা যান। এরপর দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তাকে ‘ভারমুক্ত’ করা হয়নি।

আসন্ন কাউন্সিলে তাকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করতে দলের মধ্যে জোরালো দাবি রয়েছে। এতদিন মহাসচিব হিসেবে ফখরুলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মহাসচিব হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান। তবে তিনি কখনও প্রকাশ্যে এই পদে প্রার্থী হবেন না বলে জানা গেছে। ফখরুলবিরোধীরা চাচ্ছেন, মহাসচিব হিসেবে দলের প্রবীণ নেতা তরিকুল ইসলামকে সামনে নিয়ে এগোতে। ইতিমধ্যে তারা সেই প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। তবে তরিকুল নিজ থেকে কখনও মহাসচিব প্রার্থী হবেন না।

দলের চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি তাকে প্রস্তাব দিলেই তিনি সম্মতি জানাবেন। এদের ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নামও আলোচনায় উঠে আসছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই মহাসচিব হতে আগ্রহ দেখিয়ে আসছেন। তবে এবার তিনি স্বেচ্ছায় এখনও এই পদে আগ্রহ দেখাননি। তার অনুসারীরা তাকে উদ্বুদ্ধ করছে বলে জানা গেছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদ নিয়েও চলছে নানা লবিং।

বর্তমান যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ওই পদের জন্য লবিং করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে শাহজাহান ও রিজভী এগিয়ে রয়েছেন। তবে দলের অপর একটি সূত্র জানায়, ভারতে চিকিৎসাধীন সালাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথমে মহাসচিব হতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু গুম হওয়ার পর বর্তমানে তিনি অসুস্থাবস্থায় চিকিৎসাধীন। এ মুহূর্তে তিনিও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব হতে আগ্রহী বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান।

দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, ড. আর গনি ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। এম শামসুল ইসলাম, বেগম সরোয়ারী রহমান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। এবার স্থায়ী কমিটিতে অন্তত ৫-৭টি পদে নতুন মুখ আসছে বলে নীতিনির্ধারণী সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন ঢাকার সাবেক মেয়র ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ড. ওসমান ফারুক, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তবে দলের একটি সূত্র জানায়, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদে অন্য কাউকে বসানো হলে সেক্ষেত্রে রিজভী ও সালাহ উদ্দিন আহমেদকে স্থায়ী কমিটিতে নেয়া হতে পারে।

বর্তমান গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। আসন্ন কাউন্সিলে তা পরিবর্তন করে বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদ করা হবে। সেক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ পড়া ও দলের সিনিয়র নেতা এমনকি পেশাজীবীদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেয়া হবে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবার নির্বাহী কমিটির এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান পদটিকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কোনো কারণে চেয়ারপারসন কারাগারে গেলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের মূল ভূমিকা পালন করার কথা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের। ওই পদে তারেক রহমান বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ওই পদে একজন বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন লোককে বসাতে চাচ্ছেন খালেদা জিয়া। বর্তমানে বিচারপতি টিএইচ খান এই পদে আছেন। তিনি বেশ অসুস্থ। তবে এই পদের জন্য কেউ কেউ তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের নাম প্রস্তাব করছেন। তবে এ বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও আসছে নতুন মুখ। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, লায়ন আসলাম চৌধুরী, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, হাবিব উন নবী খান সোহেল, খায়রুল কবির খোকন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবুল খায়ের ভুঁইয়া ছাড়াও বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদকদের কেউ কেউ যুগ্ম-মহাসচিব পদে আসতে পারেন।

দলের বিশেষ সম্পাদক নাদিম মোস্তফাও যুগ্ম-মহাসচিব হতে ঢাকা-লন্ডনে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম-মহাসচিবদের মধ্য থেকে অনেককে ভাইস চেয়ারম্যান করা হতে পারে। নিষ্ক্রিয়তার কারণে বর্তমান কমিটির অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ না দিয়ে একই পদে রাখ হবে।

সূত্র জানায়, দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ হচ্ছে দফতর সম্পাদক। এই পদে যিনি থাকেন কেন্দ্রীয় কার্যালয় মোটামুটি তার নিয়ন্ত্রণেই থাকে। রিজভী আহমেদের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, তাকে যে পদেই রাখা হোক দফতরের দায়িত্ব তিনি রাখতে চান। সেক্ষেত্রে রিজভীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দফতরে রাখা হতে পারে।

যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, যোগ্য এবং ত্যাগীদের পদ দেয়া হলে কে বাদ পড়ল তা নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ থাকবে না। নিষ্ক্রিয়রা আবারও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলে নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়বে। তিনি বলেন, দলের চেয়ারপারসনের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, এবার অযোগ্য ও সুবিধাবাদী নেতারা সুবিধা করতে পারবেন না।

একাধিক পদ নয় : পদের জন্য মারামারি, সংঘর্ষ এমনকি রক্তপাতের ঘটনা ঘটলেও কেউ কেউ একাধিক গুরুত্বপর্ণ পদ দখল করে আছে। এতে পদবঞ্চিত হচ্ছেন অনেক নেতা। পঞ্চম কাউন্সিলে এক ব্যক্তির এক পদ এই বিধানটি গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা পাস হয়নি। এক ব্যক্তিকে একাধিক পদে নিরুৎসাহিত করা হবে গঠনতন্ত্রে এমন বিধান রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে যেন নেতারা একাধিক পদ নিতে আরও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

কেন্দ্র, অঙ্গসংগঠন এমনকি জেলা-উপজেলার পদও দখলে রেখেছেন অনেকে।  কিন্তু এবার সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। এক নেতার এক পদ এই বিধানটি এবারের কাউন্সিলে পাস করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়। স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এমন প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, এক ব্যক্তির এক পদ থাকলে নতুন অনেককে নেতৃত্বে আনা যাবে। এতে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে।

তার এই প্রস্তাবে মৌন সমর্থন জানান খালেদা জিয়া। শুধু এক নেতার এক পদই নয়, যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন তারা জেলা ও উপজেলার কমিটিতে থাকতে পারবেন না বলেও বৈঠকে ওই নেতা প্রস্তাব তোলেন। তার এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন কেউ কেউ। তবে বেশির ভাগ সদস্যই একমত হন, যারা দলের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হবেন তারা পরবর্তীকালে দলীয় পদ ছেড়ে দেবেন। -যুগান্তর

২৯ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে