শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৩৯:২৯

সীমান্তে ভূখণ্ড হারাচ্ছে বাংলাদেশ!

সীমান্তে ভূখণ্ড হারাচ্ছে বাংলাদেশ!

জিয়াউল গনি সেলিম : গেল কয়েক বছরের অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে রাজশাহী সীমান্তে ভূখণ্ড হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাঙনের কারণে বাংলাদেশ-ভারতের বেশ কয়েকটি সীমান্ত পিলার এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় জেলেরা পদ্মায় মাছ ধরতে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের বাধার মুখে পড়ছে।

বুধবার পবা উপজেলায় ভাঙনকবলিত হরিয়ান ইউপির চর খিদিরপুর ও খানপুর এলাকায় গিয়ে এমন অভিযোগই পাওয়া গেছে।

বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাঙন প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) তাগাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বরং পাউবোর প্রকল্প প্রস্তাব এরই মধ্যে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকার ভূখণ্ড রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

চর খিদিরপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুস সাত্তার বলেন, বাড়িঘর নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে কোথাও বসবাস করতে পারেননি তিনি। সর্বগ্রাসী পদ্মার ভাঙন থেকে রেহাই পেতে অন্তত ১০ বার বাড়ি সরিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তবুও চলছে বেঁচে থাকার চেষ্টা। ফের গড়ছেন বসতঘর। শুধু আবদুস সাত্তারই নন, গেল কয়েক বছরে তার মতো শত শত মানুষ এভাবেই নিস্ব হয়ে গেছেন পদ্মার ভাঙনে। দিশেহারা হয়ে অনেকেই ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অনেকেই আবার নিরূপায় হয়ে আঁকড়ে ধরে আছেন বাপ-দাদার ভিটা।

গত বর্ষায় পদ্মা নদীর দক্ষিণ সীমান্তের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫০০ মিটার প্রস্থ ভূখণ্ড পদ্মায় হারিয়েছে বাংলাদেশ। ওই ভাঙনে চরমাঝারদিয়ার ও চর খানপুরের মধ্যবর্তী কলাবাগান এলাকার ১৬৪ নম্বর মেইন পিলার থেকে ১৬৫ নম্বর মেইন পিলার পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড নদীতে বিলীন হয়ে ভারতীয় সীমানায় মিশেছে পদ্মার পানি। এরপর থেকেই পদ্মার ওই অংশে বিএসএফ নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের মোহনগঞ্জ থেকে বিএসএফ তাদের ক্যাম্প এনে নদীর তীরে স্থাপন করে।

এবারও বর্ষায় ভাঙন অব্যাহত থাকলে দেশের আরও ভূখণ্ড ভারতের অধীনে চলে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। গেল কয়েক বছরে পদ্মার ভাঙনে ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শত শত হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বিলীন হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা পিলারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে প্রতিবছরই সীমান্ত নদীগুলোর ভাঙনে মূল্যবান জমি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্রমাগত ভাঙনে জমি পদ্মা নদীতে তলিয়ে গেছে। সামনে বর্ষাতেই বাকি ভূখণ্ড হারানোর আশংকা রয়েছে।

অনেক দেরিতে হলেও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন চর খিদিরপুর ও খানপুর এলাকায় পদ্মার গর্ভে বিলীন হওয়া ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারণে উদ্যোগ নিয়েছে। বুধবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম বাংলাদেশ-ভারত সীমানা এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি জানান, হরিয়ান ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চর তারানগর, চর খিদিরপুর, দিয়াড় খিদিরপুর, চর তিতামারি, দিয়াড় শিবনগর, চরবৃন্দাবন, কেশবপুর, চর শ্রীরামপুর ও চর রামপুরের সিংহভাগ জমিই পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে।

যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও বিলীন হতে বসেছে। আর পদ্মার তীর ভেঙে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করলেই ভারতীয় শাসন প্রতিষ্ঠার আশংকা রয়েছে। এরই মধ্যে সীমান্ত পিলার নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় ওই এলাকায় পদ্মায় মাছ ধরতে দিচ্ছে না বিএসএফ। এতে বাংলাদেশের জেলেরা বেকার হয়ে পড়ছে।

পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, পদ্মার ভাঙনে এরই মধ্যে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে চর তারানগরে ২শ’ ঘরবাড়ি, চারটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বিতল আশ্রয় কেন্দ্র, খানপুর বিজিবি ক্যাম্প এবং আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ১৬৪ ও ১৬৫ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

আবার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চর খিদিরপুরে প্রায় ৪শ’ বাড়ি, একটি বিজিবি ক্যাম্প, একটি পাকা দ্বিতল প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মসজিদ, দুটি মাদ্রাসা, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ১৫৯-এর এস-৩, ৪, ৫ নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। এ দুই ওয়ার্ডে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। ভোটার ছিল প্রায় ৩৩শ’।

বাড়িঘর, জমিজমা পদ্মার গর্ভে বিলীন হওয়ায় সব মিলিয়ে এখন দুই হাজার লোক বসবাস করছে সেখানে। কোনো স্থানে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় এবং মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করতে না পেরে এরা পড়ে আছে সেখানেই। তিনি আরও বলেন, ইউপি নির্বাচনের আগেই ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডে সীমনা নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে পদ্মার ভাঙনরোধে সীমান্তবর্তী খানপুর, খিদিরপুর, ইউসুফপুর ও চর মাজারদিয়াঢ় বিজিবির বিওপি এলাকা রক্ষার্থে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ১৭৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। এ প্রকল্পটি নিয়ে ২০১৪ সালের ৯ জুন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটির সভায় আলোচনা হয়। পরে আগস্টে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠালে তারা আপত্তি তোলে।

কিছু বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়ে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও জবাব দিয়ে মন্ত্রণালয় সেটি আবারও গত বছরের জানুয়রিতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। কিন্তু একই বছরের ২৩ এপ্রিল পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘আলোচ্য প্রকল্প থেকে ইউসুফপুরে ৭০০ মিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট কাজের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তার সরেজমিন যাচাইপূর্বক মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে’।

ওই সিদ্ধান্তের আলোকে মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। ওই কমিটি গতবছরের ৭ জুলাই সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, ‘বর্তমান অবস্থায় খানপুর, খিদিরপুর এবং চর মাজারদিয়াড় এলাকায় নদী তীর সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন নেই।’ ফলে এ প্রকল্পটি আর গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুখলেসুর রহমান বলেন, গেল বর্ষায় খানপুর ও খিদিরপুর এলাকায় খুব একটা ভাঙন ছিল না। এ কারণে এ প্রকল্পটি আপাতত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তবে সীমান্ত পিলারগুলো স্থায়ী চিহ্ন হওয়ায় ভারতের পক্ষ থেকে নদী শাসন নিয়ে কোনো আপত্তির সুযোগ নেই।  - যুগান্তর
৩০ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে