শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৫৭:৩৬

দিশাহীন হয়ে পড়েছে বেসামাল জাতীয় পার্টি

দিশাহীন হয়ে পড়েছে বেসামাল জাতীয় পার্টি

কামরুজ্জামান বাবলু : জাতীয় পার্টির চলমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসে নতুন রূপ নিয়েছে। আগে দলের চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের মধ্যে বিভাজন থাকলেও এবার তা ছড়িয়ে পড়েছে পার্টির শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও। তাই দ্বিধাবিভক্ত জাতীয় পার্টির নতুন করে সৃষ্ট এ সংকট এতটাই তীব্র যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দরবার পর্যন্তও গড়িয়েছে ব্যাপারটি।

জানা গেছে, সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তার অবর্তমানে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির উত্তরসূরি ঘোষণা করায় মূলত স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে চলা পুরনো দ্বন্দ্বের বিষয়টি আবার সামনে চলে আসে। তবে এরশাদ এবং রওশনের মধ্যকার দূরুত্বকে দলের গুটিকয়েক শীর্ষ নেতা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আরো বড় করে তুলেছেন_ এমনটিই মনে করেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, এরশাদ ও রওশনের মধ্যে ক্ষমতার ঠাণ্ডা লড়াইটি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু এবার সেটা প্রকাশ্যে এসেছে। যার ফলে দলীয় এবং সংসদীয় কর্মকান্ডের ব্যাপারে তারা কেউ কারো কথা শুনছেন না। একত্রে বসে তারা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন না। যে যার মতো চলছেন।

এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, তাদের দলের চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গে তার (এরশাদ) স্ত্রী ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশনের কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু সেটাকে বিশেষ একটি গোষ্ঠী সমাধানের পথ না দেখিয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ হাসিলে আরো বড় আকার দেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে দলের ক্ষতি হচ্ছে।

সূত্র জানায়, হঠাৎই জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে পুনরায় মহাসচিব এবং তার আগে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করায় জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল আবার প্রকাশ্যে আসে। বিশেষ করে এরশাদ যেদিন জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন তার একদিন পরেই রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল এরশাদের উপস্থিতিতেই এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়।

কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এরশাদ। পরে এক পর্যায়ে বিবৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানান সংসদীয় দলের সভাপতি ও বিরেধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। তার যুক্তি, প্রেসিডিয়ামকে না জানিয়ে ওই পরিবর্তন দলীয় গঠনতন্ত্রের লঙ্ঘন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই পাল্টা বিবৃতি দিয়ে এরশাদ বলেন, চেয়ারম্যানকে দেয়া ক্ষমতাবলেই তিনি ওই পরিবর্তন এনেছেন এবং তা আর পরিবর্তন হবে না।

এদিকে প্রায় দেড় বছর আগে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ নেতা জিয়া উদ্দিন আহমদ বাবলুকে রাতারাতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব করেন চেয়ারম্যান এরশাদ। তখন মহাসচিব হয়েই বাবলু জানান, দলের প্রয়োজনে গঠনতন্ত্রের আলোকেই তাকে মহাসচিব করা হয়েছে।

কিন্তু এবার ঠিক একই কায়দায় যখন বাবলুকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে পুনরায় মহাসচিব পদে বসানো হয় তখন বিষয়টিকে অগণতান্ত্রিক বলে চাউর করেন জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সমর্থনকারী দলের একটি অংশ। বিশেষ করে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং মশিউর রহমান রাঙ্গাদের একটি গ্রুপ।

যদিও বাবলু মহাসচিব হওয়ার পরদিনই এ নিয়ে সংসদে তাকে চোখ উপড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন ওই গ্রুপের নেতারা। এ নিয়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরে জিয়া উদ্দিন বাবলুর সঙ্গে রাঙ্গা তাজুলের অনেকটা সাপে নেউলে সম্পর্ক পার হয়েছে। কিন্তু যখনই মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তখনই কাল বিলম্ব না করে এরশাদকে ছেড়ে রওশনের দিকে ইউটার্ন নেন সাবেক এ মহাসচিব।

ফলে শীর্ষ নেতাদের এত দ্রুত বোল ও পক্ষ পাল্টানোর দৃশ্যে রীতিমতো হতবাক হন দলের মধ্যম ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। যদিও এরশাদ যখন জিএম কাদেরকে দলের উত্তরসূরি ঘোষণা করলেন, তখনই এরশাদপন্থী বলে পরিচিত মহাসচিব পদে থাকা জিয়াউদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সেদিন রাতেই রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।

এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও একান্তে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ। তার জবাবে রওশনের বৈঠকের পরপরই দলের চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ৩১ জানুয়ারি দলের প্রেসিডিয়ামের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। ওইদিনই দলের মধ্যে আনা সকল পরিবর্তন সম্পর্কে প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অবহিত করা হবে জানান নেতারা।

মূলত দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা নাটকীয়তার পর রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার পর থেকেই মূল দ্বন্দ্বটা শুরু হয়। কারণ সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ চাপে এরশাদ নির্বাচনে গেলেও কোনোভাবেই রওশনকে প্রধান বিরোধী দলের আসনে দেখতে চান না তিনি। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে গেজেট প্রকাশের পর রওশন দলের চেয়ারম্যান হতেও এখন মরিয়া। এজন্য শীর্ষ নেতাদের পরস্পরবিরোধী আচরণে দলের অভ্যন্তরে আস্থার সংকটও চরমে উঠেছে।

এরশাদ ও রওশনের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানান, দলের কর্তৃত্ব ভাগাভাগি নিয়ে দু'জনের মাঝে চলা টানাপড়েনটা এবার একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। রওশন চাচ্ছেন দলের এমপিরা তার কথা মতো চলবে। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এরশাদকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতেও নারাজ তিনি। অপরদিকে, পার্টির সব কর্তৃত্ব আগের মতোই নিজের কব্জায় রাখতে চান এরশাদ।

এর আগে অনেক দিন থেকেই মন্ত্রিত্ব আর সরকারের সঙ্গ ছাড়ার হুমকি দিয়ে আসছেন এরশাদ। তবে তার কথা-কাজে মিল না পাওয়ায় সব মহল থেকেই কঠোর সমালোচনার শিকার হন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। এজন্য এবার জাতীয় পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দলে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমি আসলে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারছি না। কারণ আমি একদিকে সরকারে সম্পৃক্ত আছি এবং আরো তিনজন সরকারে সম্পৃক্ত আছে। যতদিন আমরা বেরিয়ে আসতে না পারব ততদিন সঠিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারব না।'

এরশাদের এমন দৃঢ় অবস্থানের পরই বৃহস্পতিবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ। বৈঠক শেষে রওশন জানান, তার দল সরকার থেকে বেরিয়ে আসছে না। - যায়যায়দিন
৩০ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে