সোমবার, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৩:৩৯:০৪

সংবাদপত্রের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত

সংবাদপত্রের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত

সৈয়দ আবুল মকসুদ : গণতন্ত্রহীন সমাজেই সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু। তখন সংবাদপত্রের দায়িত্ব ছিল সমাজকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করা। মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরা, গণতান্ত্রিক চেতনাকে শাণিত করা। তারপর গণতন্ত্রের যুগ এলো। একটি ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্র তার স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করে।

সমাজ ও রাষ্ট্রের বিচিত্র কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র নেই অথবা থাকলেও আছে নামে মাত্র কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, সেখানে সংবাদপত্রের ভূমিকা খুব বড়। সেখানে তার দায়িত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। সেখানে তাকে গণতন্ত্রকামী মানুষের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়। তা করতে গিয়ে তাকে বিপদের মধ্যে পড়ার ঝুঁকি নিতে হয়।

কোনো জাতির জীবনে কখনও এমন সময় আসে যখন রাষ্ট্র স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনাচার-অবিচার করতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকদের পক্ষে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সে অবস্থায় সংবাদপত্রকে নাগরিকদের পক্ষ অবলম্বন করতে হয়। ফলে তার অবস্থান হয় সরকারের বিরুদ্ধে। সেই সরকারবিরোধিতা রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়, বরং তাতে রাষ্ট্র আরও বেশি শক্তিশালী ও সংহত হয়।

বাংলাদেশে সবসময় দুই ধারার সংবাদপত্র ছিল। মূলধারার সংবাদপত্রগুলো জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করেছে। এর পাশাপাশি অপ্রধান একটি ধারা সব সময়ই ছিল, যা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা সরকারের অন্ধ সমর্থক। সরকারের গঠনমূলক কাজগুলোর প্রশংসা করা নিরপেক্ষ সংবাদপত্রগুলোর কর্তব্য। জাতীয় স্বার্থে সরকারের নীতি ও কাজের সমর্থন না দেয়াই বরং দোষের।

সংসদীয় গণতন্ত্র হল দলীয় রাজনীতিনির্ভর। বিভিন্ন দলের মুখপত্র আজকাল সব গণতান্ত্রিক দেশেই থাকে। আবার দলের মুখপত্র নয়, কিন্তু বিশেষ দলকে সমর্থন দেয় কোনো কোনো কাগজ। এই সমর্থন তারা স্বাধীনভাবেই দেয়, কোনো সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় নয়। ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কাগজ প্রতিপক্ষ কাগজের প্রতি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে।

শুরু থেকেই বাংলাদেশে তেমন দৃষ্টান্ত প্রচুর। এটা ব্রিটিশ আমলেও ছিল, পাকিস্তানি আমলেও ছিল, বাংলাদেশ আমলেও রয়েছে। যেমন, রক্ষণশীল আজাদ পত্রিকা অন্য প্রগতিশীল কাগজকে অনেক সময় অকারণেই গালাগাল দিত। অন্যরাও আজাদকে ছেড়ে দিত না। এতে সংবাদপত্রের শক্তি ক্ষয় হয়, গঠনমূলক ভূমিকা পালন করা হয় না। পাঠক হয় বিভ্রান্ত।

গত কয়েক দশক ধরে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এতটা ছিল না। উপসম্পাদকীয় লেখার প্রচলিত নাম কলাম। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টিতে দৈনিক ইত্তেফাকের খোন্দকার আবদুল হামিদের উপসম্পাদকীয়গুলো খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে দৈনিক সংবাদে জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার-ই-জহুর’ এবং আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তুলে ধরতে রেখেছে অসামান্য ভূমিকা।

তবে পত্রিকার নিজেরই যেমন প্রতিপক্ষ থাকে- তাকে অবশ্য শত্রুতা বলা যায় না- তেমনি বহু কলাম লেখকও ব্যক্তিগত বৈরী মনোভাবের প্রকাশ ঘটান তাদের রচনায়। রাজনৈতিক বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে তারা অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন এবং শুধু খোঁচা দেয়া নয়, রীতিমতো ঝগড়াটেমূলক বক্তব্য দেন। লেখক যদি বিখ্যাত ও প্রবীণ হন, তাহলে সাধারণত আমাদের দেশে সম্পাদক তার লেখায় হাত দেন না। নিরপেক্ষ পাঠকই শেষ পর্যন্ত বিচার করেন। সিদ্ধান্ত দেন লেখকের বক্তব্য কতটা যৌক্তিক।

আশির দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে কয়েকটি কাগজের কলাম লেখকরা খুবই সাবলীল ভূমিকা রেখেছেন। নব্বইয়ের দশকেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। সেজন্য কৃতিত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কাগজের সম্পাদক-প্রকাশকদেরও। যুক্তিপূর্ণ সমালোচনায় কাজ হয়।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় বর্তমান সংসদে কার্যত তা নেই। কয়েকজন নির্দলীয় সংসদ সদস্য ছাড়া সবাই মূলত সরকারিদলীয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অবস্থাটা অস্বাভাবিক। প্রধান বিরোধী দলের জোট রয়েছে সংসদের বাইরে রাজপথে।

সংসদে যে বিরোধী দল নেই, সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে এবং পূরণ করতে হবে সংবাদপত্রকে। জনগণের দাবি-দাওয়া ও আশা-আকাক্সক্ষা সংবাদপত্রকেই তুলে ধরতে হবে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মতো। সরকারের ভুলভ্রান্তিও বিরোধী দলের মতো সংবাদপত্রকেই তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ যে অবস্থায় গেছে, সেখানে রাজনীতিকদের ওপর মানুষের ভরসা কমে গেছে, সংবাদপত্রের ওপর মানুষের ভরসা বেড়ে গেছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

আমাদের সংবাদপত্রকে বিভিন্ন সময় অনেক রকম কঠিন অবস্থা পার হয়ে আসতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে তার ভূমিকা ছিল একরকম। তখন মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি। স্বাধীনতাই যদি না থাকে, তাহলে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা ভাবাই যায় না।

পাকিস্তানি আমলে সংবাদপত্রকে দুটি প্রধান লক্ষ্যে কাজ করতে হয়েছে : পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ওই দুটির একটিও যখন পাওয়া যাচ্ছিল না এবং এর পরিবর্তে পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনে নেমে আসে নিপীড়ন, তখন পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জনগণের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হয় সংবাদপত্রকে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সংবাদপত্র আরেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। দেশ স্বাধীন হল কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হল না। এর পরিবর্তে যখন একনায়কের পদধ্বনি শোনা গেল, তখন সংবাদপত্র তার প্রতিবাদেও কলম ধরে। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য সংবাদপত্রের নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র তো গেলই, তার পরিবর্তে পাওয়া গেল একদলীয় শাসন, তার পরপরই সামরিক শাসন।

একদলীয় শাসনে যেমন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে না, সামরিক শাসনে তো ভাবাই যায় না। কিন্তু গণতন্ত্রহীন অবস্থাতেই সংবাদপত্রের প্রকৃত পরীক্ষা হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তার যে ভূমিকা সেটাই সংবাদপত্রকে করে মহিমান্বিত। আজ বাংলাদেশের সংবাদপত্র এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। সংসদীয় গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়েছে। তাকে পুনরুদ্ধার করতে গণতন্ত্রকামী নেতাদের সঙ্গে সংবাদপত্রকেও সাহসী ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করতে হবে।

একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকের সগৌরবে টিকে থেকে ১৭ বছরে পদার্পণ করা তার জন্য খুবই শ্লাঘার বিষয়। যুগান্তর ১৭ বছরে পড়ছে, যা তার সাংবাদিক-অসাংবাদিক কর্মীদের জন্য শুধু নয়, পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদের জন্যও সুসংবাদ। এই শুভ লগ্নে আমি একজন লেখক ও পাঠক হিসেবে যুগান্তরকে অভিনন্দন জানাই। যুগান্তর

সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক
০১ ফেব্রুয়ারী,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে