নূরে আলম সিদ্দিকী : হজ্ব মুসলমানদের জন্য ফরজ হিসেবে বিবেচ্য; যার অর্থ এবং আনুষঙ্গিক যথোপযুক্ত সামর্থ্য রয়েছে। যদিও ওমরাহ্ হজ্ব ও জিয়ারত ফরজ নয়। ধার্মিক সকল মুসলমানের জন্য ওমরাহ্ হজ্ব ও জিয়ারত কাঙ্ক্ষিত। নিয়ত করে যেতে না পারলে অনুভূতি ও মননশীলতা প্রচণ্ডভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আমি আলেম-ওলামা নই। ধর্ম বিষয়ে আমার জ্ঞানের পরিধি সীমিত।
বেশ অনেকদিন হলো, ওমরাহ হজ্বের ভিসা পৃথিবীজুড়ে চালু হয়েছে, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। অথচ বাস্তবে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এই তো সেদিন আইএস বিরোধী যে মোর্চা গঠিত হলো, দ্বিধাহীন চিত্তে ও অকপট মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশ এই মোর্চায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
মানুষ উদ্বেলিত চিত্তে এই যোগদানটিতে গ্রহণ করেছে। কোন দল-মত থেকে এর কোন বিরোধিতা তো দূরে থাক, বিন্দুমাত্র সমালোচনা হয়েছে বলেও সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিক মাধ্যমে আমার নজরে পড়েনি। আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর হলেও সত্য, পাকিস্তান এই মোর্চায় অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
বাংলাদেশ জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতায় উজ্জীবিত বলেই পৃথিবীতে আপন গৌরবে যেমন অধিষ্ঠিত, ঠিক তেমনি ধর্মীয় আবেগপ্রবণতায় পৃথিবীর একটি দৃষ্টান্তের দেশ। ওমরাহ্ ভিসা যখন উন্মুক্ত হলো, পৃথিবীর সব দেশকে যখন ওমরাহ্ ভিসা’র অনুমতি প্রদান করা হলো, তখন বাংলাদেশের জন্য এটা স্থগিত রইল। এটা শুধু কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য লজ্জাকর। কোন দেশই যদি ওমরাহ্ হজ্বের অনুভূতি না পেত, তাহলে সেটি হতো অন্য কথা।
সারা বিশ্বের এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পাশ্চাত্যের সকল দেশ এমনকি চীন, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমারের জন্য যখন ওমরাহ্ ভিসা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে তখন বাংলাদেশের ওমরাহ্র অনুমতি না পাওয়ায় সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কেবল ক্ষুণ্ন হয় নাই, প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে।
এটি ধর্ম ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নয়, এ ব্যর্থতা সরকারের, এ লজ্জা ১৬ কোটি মানুষের। বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা অবহিত, সৌদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য অনুমতি প্রদান করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে আটকে রেখেছে পররাষ্ট্র, ধর্ম অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে মন্ত্রিপর্যায়ে আলোচনার অপেক্ষায়।
বাস্তবতার নিরিখে অথবা নৈতিকতার খাতিরে উল্লেখ্য যে, গতবছর জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ৫১,৩২১ জন পবিত্র ওমরাহ্ করতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১১,৪১৭ জন আর দেশে ফেরেননি। এর দায়ে দেশের ৪৭টি হজ্ব এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এটিও কোন কারণ হতে পারে। যদিও তা সত্ত্বেও সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের জন্য ওমরাহ্ ভিসা ছাড় দিয়েছে। এখন বিষয়টি আটকে রয়েছে পররাষ্ট্র অথবা স্বরাষ্ট্র বিষয়ক যে কোনো মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠকে। তাহলেই বিষয়টির সমাধান হয়।
এদেশের সাধারণ মানুষ মোটেও অবহিত নয়, উপরোক্ত তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কোন ব্যস্ততায় ব্যাপৃত যে, এই বৈঠকটি অনুষ্ঠানের জন্য সৌদি আরব যেতে পারছেন না। সরকার-প্রধানেরও এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। শুধু ধর্মীয় নয়, এটা জাতীয় প্রত্যাশা।
সংসদ অধিবেশন চলছে। বন্দনা, অর্চনা, স্তুতি, কাকুতি-মিনতির পাশাপাশি অন্তত এই অধিবেশনে কিছু তথ্যভিত্তিক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর মন্ত্রণাভিত্তিক আলোচনাও হচ্ছে। সংসদে মন্ত্রিপরিষদের প্রধানকে প্রশ্ন করারও দিন নির্ধারিত রয়েছে; কিন্তু কোথাও এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উত্থাপিত হলো না কেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। পৃথিবীর সকল দেশের প্রাপ্ত সুযোগ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হলে সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- এটা ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই অনুধাবন করা উচিত ছিল।
আন্তর্জাতিক পরিভ্রমণে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে (কতিপয় সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া) প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের প্রতি বাংলাদেশ দূতাবাস কেমন যেন উদাসীন ও নির্বিকার। যাদের বুকের রক্ত পানি করা উপার্জিত অর্থে আমাদের রিজার্ভ বাড়ে, সেইসব দুর্ভাগা মানুষ বিদেশে দূতাবাসে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের লোকদের দ্বারা তেমন কোন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান না। অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে প্রবাসে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সুনাম ও সুখ্যাতি কত প্রশস্ত ও বিস্তীর্ণ। অর্থ মন্ত্রণালয় জানে বাংলাদেশের রিজার্ভ গঠনে তাদের বুকের রক্ত পানি করা অর্থ কতখানি অবদান রাখে।
আজকে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে এমনকি ছোট্ট রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরেও বাংলাদেশী পাসপোর্টে ভিসা পেতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করতে হয়। বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য যেতে চাইলে ডাক্তারের নির্ধারিত তারিখ, ওখানকার ডাক্তারদের ই-মেইলে অনুনয়-বিনয়, ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ই-মেইল প্রদান, কোনোটাতেই যেন তাদের টনক নড়ে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের বিমানবন্দর থেকে ভিসা সংগ্রহ করে থাকে।
বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিবেচনার কোন স্তরে আছে আমার জানা নেই। পৃথিবীর সকল দেশ ওমরাহ্ ভিসা সুবিধা ভোগ করার পরও বাংলাদেশ অচ্যুত হলো কেন? এখনও সরকার যদি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে এর সুষ্ঠু ও সম্মানজনক সমাধান না করেন- তবে দেশের অভ্যন্তরে ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতি বিষণ্নতায় চৌচির তো হবেই, বিশ্বের কাছেও আমরা খাটো হয়ে যাব। -মানবজমিন
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস