বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৫:০৭:৫০

মিয়ানমারের নতুন সরকার ও রোহিঙ্গা সংকট

মিয়ানমারের নতুন সরকার ও রোহিঙ্গা সংকট

এএইচএম জেহাদুল করিম : বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুটিই প্রতিবেশী দেশ এবং এই দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭১ কিলোমিটার। জাতি, ধর্ম ও ভাষার বিভাজনে এই দুই দেশের মধ্যে বাহ্যত অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের প্রায় সম্পূর্ণই মিল রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রসঙ্গতঃ আরাকান সবসময়েই বার্মার অন্তর্ভুক্ত ছিল না, বরং মধ্যযুগে আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, এবং সেই সময় এর পরিধি চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রখ্যাত লেখক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং গবেষক ড. এনামুল হকের তথ্য থেকে জানা যায়, মধ্যযুগের এক পর্যায়ে আরাকান রাজ্যসভাই ছিল মুসলিমভিত্তিক বঙ্গীয় সাহিত্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র।

রোহিঙ্গারা মূলত সেই আরাকান রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, যারা ব্রিটিশ ও প্রাক-ব্রিটিশ সময় থেকেই বহির্গমনের মাধ্যমে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীকালে মিয়ানমারের কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্ররোচনায় এবং তাদের পরোক্ষ ইঙ্গিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক অমানবিক অত্যাচার চালায়।

অনেকটা সে কারণেই ১৯৪০ সালের দিকে আরাকানে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য স্থাপনের দাবিও উঠেছিল; কিন্তু কার্যত এ ধরনের সেন্টিমেন্ট সম্ভবত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে কার্যকর হতে পারেনি। এ ছাড়া এ ধরনের সেন্টিমেন্ট যাতে কার্যকর হতে না পারে তার জন্য বার্মিজ সেনাশাসকরা পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের একটি জাতিগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়।

জাতিভিত্তিক বিভাজনকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য, বার্মার সরকার আরাকান রাজ্যের নাম বদলে একে রাখাইন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ ঐতিহাসিক সূত্র থেকে এটি অত্যন্ত স্বচ্ছ যে বর্তমানে মিয়ানমারে যেসব জনগোষ্ঠী বসবাস করছে, রোহিঙ্গারা তাদেরও অনেককাল আগে থেকেই আরাকান রাজ্যে বসবাস করছে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী অর্ধেকের বেশি রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক বার্মার বহিরাগত, তাদের অনেকেই রোহিঙ্গাদের অনেক পরে আগমন করে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৫০-এর দশকের মধ্যভাগে, বর্মার বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনা ছড়িয়ে পড়লেও, রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় বলয়ের মধ্যে থেকেই তাদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হয়। ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী উনু দেশে সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে সে দেশের সামরিক প্রধান জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন।

জেনারেল নে উইন যথারীতি তার কাজ সম্পন্ন করে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী উনুর কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মধ্যেই ১৯৬২ সালে বার্মার সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে এবং রোহিঙ্গাসহ সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবিধানিকভাবে অর্জিত অধিকারগুলোর বিলুপ্তি ঘটায়।

মিয়ানমারে কিছুদিন আগে পর্যন্ত নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্রচর্চা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণভাবে সামরিকীকরণের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত ছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অং সান সু চির দীর্ঘ বন্দি-অবস্থা এই পরিস্থিতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ২০১০ সালে অং সান সু চি তার বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তার নিজস্ব রাজনৈতিক প্রটেকশনের জন্য তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেননি, বরং পরোক্ষভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘The government is now verifying the citizenship status under the 1982 citizenship law. I think they should go about it very quickly. কিন্তু এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৮২ সালের বর্মি নাগরিকত্ব আইন একটি অগৃহীত দলিল এবং আন্তর্জাতিকভাবে এটি কখনও গ্রাহ্য নয়। মূলত রোহিঙ্গাদের দাবি খর্ব করার জন্যই বার্মার সামরিক সরকার সেই সময়ে এই কালো আইন প্রণয়ন করে।

যাই হোক, এরই মধ্যে ১৯৫৮, ১৯৭৮ এবং সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে তাদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়ে। অতি সম্প্রতি একজন নিবন্ধকার ১৯৯১-৯২ সালে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কমিশনের তথ্যের সূত্র উদ্ধৃত করে জানান, বাংলাদেশে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন।

কিন্তু সত্যিকারভাবে মাত্র ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত রয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘ শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে বাংলাদেশ সরকার এ কথাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, নিবন্ধনের বাইরে অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।

আমাদের ধারণা, এই সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া কূটনৈতিকভাবে যৌক্তিক; কেননা, এতে করে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। রেজিস্ট্রেশন থাকলে হিসাবের বাইরে যেসব রোহিঙ্গা সহজভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাঙালি হিসেবে সমাজে বসবাস করতে শুরু করেছে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কেননা অনেক রোহিঙ্গাই বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।

একজন সৌদি প্রবাসী বাঙালির তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি, হজের সময় সেখানে যেসব বিভিন্ন হোটেল ব্যবসায়ী লক্ষ্য করা যায়, তাদের বেশিরভাগই মূলত রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত বর্মী নাগরিক, যাদের পাসপোর্ট প্রদান করা হয়েছে বাংলাদেশি বলে। সরকারকে এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে বলা যায়।

রোহিঙ্গাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয় যে মিয়ানমার সরকার, বর্মি জনসাধারণ এবং সর্বোপরি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রচণ্ড অত্যাচারের কারণে রোহিঙ্গারা বিশ্ব মানবচক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে অনিশ্চিত সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। এ পরিস্থিতিতে, রোহিঙ্গা শরণার্র্থীদের সংকট সমাধানে এই সময়ে মিয়ানমারের প্রতি প্রচণ্ড বিশ্বচাপ সৃষ্টি হয়েছে।

আশিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়া অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে রোহিঙ্গা বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে এবং কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী এটি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, রোহিঙ্গা সমস্যা অন্য দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয় বরং মিয়ানমারকেই এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধান বের করতে হবে। গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা রোহিঙ্গা বিষয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন রোহিঙ্গাদের মানবেতর পরিস্থিতি নিয়ে, হোয়াইট হাউস প্রতিনিধি এরিক সুজ তার বক্তব্যে সেটি উল্লেখ করেন।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যু ও তাদের শত বছরের প্রকৃত ইতিহাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতিগোষ্ঠীকে অবহিত করা প্রয়োজন, যেটি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও তাদের নাগরিকত্ব পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করবে। বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আন্তর্জাতিক জনমতের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্বুদ্ধ করা যাবে।

বিশেষ করে, দক্ষিণ এশীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো এবং পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলোর সমন্বয়ে অতি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশকেই তার লিয়াজোঁ-নেতৃত্ব দিতে হবে। সম্প্রতি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ অভাবনীয় জয় পেয়েছে এবং নোবেল বিজয়ী এই নেত্রীর দল এরই মধ্যে নতুন পার্লামেন্টে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ও মুসলিম জনগোষ্ঠীও তার এই বিজয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, রোহিঙ্গারা এই নির্বাচনে, তাদের ভোট প্রদান করতে পারেননি। অং সান সু চি একজন আন্তর্জাতিক নেত্রী এবং বিশ্বে তার এক বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

আমরা আশা করব, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আর্থ-সামাজিক এবং ভৌগোলিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই দেশগুলো নিজেদের আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি করতে পারবে এবং সেই পরিসরেই রোহিঙ্গা সমস্যারও দ্রুত সমাধান হতে পারে বলে আমাদের ধারণা। -সমকাল

সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে