বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৫:৪৫:৪১

টার্গেট খালেদা

টার্গেট খালেদা

মজুমদার ইমরান : মামলার টার্গেটে পরিণত হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। দুর্নীতি, সহিংসতা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে একাধিক মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের মতে, নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে খালেদা জিয়া যাতে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সে জন্যই তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের পূর্বেই যে কোনো মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে দলটির মধ্যে।

এমন আশঙ্কা শুধু বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেই নয়, কূটনীতিকদের মধ্যেও রয়েছে। কয়েকদিন আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বাসভবনে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বৈঠকেও এমন আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বিএনপির কাউন্সিলসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

এ সময় বার্নিকাট বিএনপি চেয়ারপার্সনের নামে একাধিক মামলা বিচারাধীন থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চেয়েছেন, যদি মামলায় তিনি জেলে যান তাহলে বিএনপির নেতৃত্বের কী হবে। দলের কর্মকাণ্ড কিভাবে চলবে এই বিষয়টিও জানতে চান। ওয়ান ইলেভেনের মতো বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারে এমন কথা দলের অভ্যন্তরেও আলোচনা হয়।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন অনেক কঠিন সময় পার করেছেন খালেদা জিয়া। ওয়ান ইলেভেনেও দীর্ঘ সময় তিনি কারাগারে ছিলেন, তাতে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সমস্যা হয়নি।

নেতাকর্মীরা এই ধরনের পরিস্থিতি অতীতের মতো মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতিও রেখেছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অস্তিত্বই ভোটারবিহীন সরকারের ভয়ের প্রধান কারণ। এজন্য সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। জিয়া পরিবার এখন সরকারের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, খালেদা জিয়া হলেন জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক। যত ষড়যন্ত্রই হোক জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিটি সৈনিক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও খালেদা জিয়ার জন্য লড়াই সংগ্রাম করবে। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগণ সরকারের সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক একটি সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। তার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হাস্যকর। এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। সময় হলেই তা জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপরও বিএনপি চেয়ারপার্সন আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিটি মামলা আইনিভাবে মোকাবিলা করছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার খারাপ সময় যেন কিছুতেই কাটছে না। বিগত আট বছর ধরে তার দল বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। একটি নতুন জাতীয় নির্বাচন আদায়ের দাবিতে তার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে এলেও দাবি আদায়ের আলোর রেখার সন্ধান মিলছে না।

বরং মামলা-হামলার শিকার হয়ে তার দলের নেতাকর্মীরা দিশেহারা। দুই দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে খালেদা জিয়া এখন তার দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মার্চে বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এমন প্রস্তুতির মধ্যেই দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগের একজন আইনজীবী নেতা।

এই মামলায় আগামী ৩ মার্চ খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের একটি আলোচনা সভায় খালেদা জিয়া বলেন, আজকে বলা হয় এত লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।

আসলে কত লাখ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানা রকম তথ্য আছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের বক্তব্য ঘিরে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোমতাজ উদ্দিন মেহেদী দেশদ্রোহী মনোভাবের অভিযোগ করে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর খালেদা জিয়াকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে উকিল নোটিশ পাঠান।

উকিল নোটিশে খালেদা জিয়াকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। উকিল নোটিশের জবাব না দিলেও বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নোংরা রাজনীতি না করার আহ্বান জানান।

পরে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে উকিল নোটিশের জবাব না পেয়ে মোমতাজ উদ্দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেন। ২১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলা দায়েরের অনুমতি দেয়। এরপর ওই আইনজীবী আদালতে ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি দায়ের করেন। ওইদিনই আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। তাকে ৩ মার্চ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

এদিকে বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে যাত্রী হত্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। আগামী ২ মার্চ অভিযোগ গ্রহণের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এই মামলায় খালেদা জিয়াকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

২০১৫ সালের ৬ মে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) বশির উদ্দিন ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এতে খালেদা জিয়াসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে ড্যান্ডি ডায়িং ঋণখেলাপির মামলাও। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম খানের দায়ের করা এই মামলায় অর্থ ঋণ আদালতে আগামী ১ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান সোনালী ব্যাংক থেকে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। পরে এই ঋণের টাকা তারা ফেরত দেননি। বর্তমানে ঋণের পরিমাণ ৪২ কোটি ৬৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। কোকো মারা যাওয়ায় ওয়ারিশ সূত্রে এই মামলায় খালেদা জিয়া, আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ড্যান্ডি ডায়িংয়ের ৪৫ কোটি টাকা ঋণ খেলাপের মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

এই মামলাটি ঢাকার অর্থঋণ আদালত ১-এ বিচারাধীন। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও ট্রাস্ট দুর্নীতির দুটি মামলার বিচার কাজ চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই দুটি মামলা দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এই দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে আসামি করা হয়েছে। - মানবকণ্ঠ

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে