এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ৬০ বছর বয়সী আবুল কাশেম ভূঁইয়া। সোমবার আন্তঃনগর এগারো সিন্দুর ট্রেনটিতে করে ঢাকায় আসছিলেন। ছিলেন শেষ দিকের দুই নম্বর বগিতে। হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেনে প্রবল ধাক্কা। ভেঙে চুরমার ট্রেনের বগি।মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় তার শরীর।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে তার। আবুল কাশেম ভুলতে পারছেন না দুর্ঘটনার ভয়াবহতা। তিনি বলেন, ট্রেনে তার পাশে থাকা যাত্রীর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, বিকালে কিশোরগঞ্জ থেকে এগারো সিন্দুর ট্রেনে ঢাকায় রওনা হই।
ভৈরব আসা মাত্রই ট্রেনটিতে একটি ধাক্কা লাগে। এরপর আরও দুই-তিনটা ধাক্কা। ট্রেনের যাত্রীরা এদিক সেদিক ছিটকে পড়ে। চারপাশে চিৎকার-চেঁচামেচি। এরপর আর কিছু মনে নেই। এখন সারা শরীরে ব্যথা। হাত-পা ভেঙে গেছে, নড়াতে পারি না। বুকেও ব্যথা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার আগে ট্রেনটি দুই-তিনবার হুইসেল দিয়েছে। খুব স্পিডে চলছিলো। বুঝতে পারিনি যে এইভাবে মুহূর্তেই এত মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাবে। এত মানুষ পঙ্গু হবে। এরপর কী হয়েছে সেটা খুব বেশি মনে নেই।
তবে একটু একটু হুশ ছিল আমার। টের পেলাম কেউ আমাকে থেঁতলে যাওয়া ট্রেনের মধ্যে থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে পাশে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখেছে। সেখানে ১৫-২০ মিনিটের মতো পড়েছিলাম। আর কেউ ধরেও না আমাকে। আশেপাশেও কেউ তেমন ছিল না।
তখন মনে হচ্ছিলো মারাই যাবো, আর বাঁচবো না। কিছুক্ষণ পরে একজন এসে আমাকে একটা রিকশায় মেডিকেলে নিয়ে যায়। আমার পাশে বসা ছেলেটির মাথা কেটে যায়। বগির সব লোক উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। কেউ উঠতে পারছিল না।
এত বেশি লোক ছিল বগিতে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। ঘটনাস্থলেই অনেকে মারা গেছে। সেখানে অনেকে ছিল গলাকাটা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে হাত-পা। এমনও দেখেছি কোমর পর্যন্ত কেটে গেছে। আর পাঁচ মিনিট পরে বের করলে হয়তো আমিও মারা যেতাম। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
আবুল কাশেমের মেয়ে জীবননাহার বলেন, আমাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ১০ দিন আগে বাড়িতে যাই। সেখানে আমার মা ভাই-বোন থাকে। ঘটনার দিন বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল আব্বু। ঢাকায় ভাঙাড়ির ব্যবসা করেন বাবা। আমি ঢাকাতে ছিলাম।
হঠাৎ করে বিকালে কল আসে আমার বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। তারপর আমি আমার আব্বুর নম্বরে কল দিলে একজন পুলিশ সদস্য ফোন রিসিভ করে বলেন আপনার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে তার জ্ঞান নেই, দ্রুত আসেন।
ওই একই ট্রেনে আমার ফুপু-কাকাসহ ছোট ভাই-বোন ছিল। তারা সামনের বগিতে ছিল। তাই তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। এরপর আব্বুর খবর শুনে কাকা খুঁজতে থাকে। পরে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে যায়।
এরপর ঢাকায় নিয়ে আসেন। বাবা গুলশান নতুন বাজারে একাই থাকে। আমি পুরান ঢাকায় থাকি। আমার বড় ভাই সাভার থাকে। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। বাবার সারা শরীর জখম।
কোনো কিছু মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেট ফুলে যায়। পায়ের মাংস কেটে গেছে। হাত ভেঙেছে। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যে আঘাত নেই। আমার আব্বুর ভাঙাড়ির এই ব্যবসা দিয়ে সংসার চলে। এখন কীভাবে সে কাজ করবে, কীভাবে সংসার চালাবে।
অন্যদিকে জীবিকার তাগিদে এক বছর ধরে ঢাকায় থাকতেন খালেক। গত সোমবার এগারো সিন্দুর ট্রেনটিতে করে ঢাকায় আসছিলেন তিনি। ছিলেন একদম শেষ বগিতে।
ভৈরব পার হওয়ার পর হঠাৎই একটি শব্দ শুনতে পান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের কোচটি উল্টে গিয়ে দূরে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তের তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। ভেঙে যায় পা।
খালেক জানান, দুর্ঘটনার পর তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু পুরো শরীর অবশ হয়েছিল। নড়াচড়া করার শক্তি ছিল না। তার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। খালেক বলেন, পুরো শরীর অনেক ব্যথা করছে। পায়ের হাড্ডি ভেঙে গেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন শাহজাহান ও তার স্ত্রী হালিমা খাতুনও। তারা দু’জনই চিকিৎসা নিয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালে।
শাহজাহান ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি শেষ কোচে ছিলাম। পাশে আমার বউ বসা ছিল। আমরা কেউ কোনো কিছু টের পাইনি। হঠাৎ করে শব্দ শুনলাম আর ট্রেনটা একদম উল্টে গেল। ট্রেনের নিচে পড়েছিলাম।
পা কিছুর সঙ্গে আঘাত লেগে ভেঙে গেছে। হাতের আঙ্গুলও ভেঙেছে। ট্রেন উল্টে যাওয়ার পর তখন একটুও নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। আশেপাশের লোকজন এসে আমাকে টেনে বের করছে। তখন চারপাশে শুধু মানুষের চিৎকার শুনছিলাম। অনেকের হাত পা কেটে গেছে। কারও মাথা ফেটেছে। গলা কেটে গেছে। সবাই আঘাত পেয়েছে।
২১ বছর ধরে ট্রেনে কাজ করেন বাহারউল্লাহ। এগারো সিন্দুর ট্রেনটিতে এটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করেন। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ট্রেনের তিনটি কোচের মাঝেরটায় ছিলেন তিনি।
বাহারউল্লাহ বলেন, আমি গেটের সামনে ছিলাম। সামনের বগির একটা শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছি দুর্ঘটনা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে গেট থেকে লাফ দিয়েছি। লাফ দিয়ে উল্টে দূরে গিয়ে পড়ি।
লাফ না দিলে হয়তো বাঁচতাম না। পা মচকে গেছে। ভাগ্য ভালো ট্রেনের গতি কম ছিল। নইলে আরও মানুষ মারা যেত।