মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪, ১০:৩৭:৪৮

বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবা-মায়ের জীবনের গল্পটাও অনেকটা একই

বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবা-মায়ের জীবনের গল্পটাও অনেকটা একই

শরিফুল ইসলাম: একসময় বড় ব্যবসা, সংসার সবই ছিল ষাটোর্ধ্ব আক্কাস আলীর। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। 

দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তিন ছেলের দুজন করেন ব্যবসা, একজন করেন চাকরি। সবকিছু মিলে বাকি জীবনটা সুন্দর কেটে যাবে আশা করেছিলেন তিনি। তবে যে সন্তানদের সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, তারাই আজ তার কেউ আপন নয়।

আক্কাস আলীর বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে। সম্প্রতি তার ঠাঁই হয়েছে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিভৃত পল্লিতে গড়ে ওঠা নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু আক্কাস আলীই নন, তার মতো অনেক অসহায় মা-বাবা বসবাস করছেন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের জীবনের গল্পটাও অনেকটা একই। কেউ সন্তানদের মানুষ করতে নিজেকে উজাড় করেছেন। কেউ কেউ হয়েছেন প্রতারণার স্বীকার। 

আবার কেউ সন্তানের নির্যাতনের ভয়ে ঠাঁই নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। চোখে-মুখে যাদের বয়সের ভাঁজ, এক অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দী তারা। পরিবারের শোকে অনেকেই হয়েছেন নির্বাক। এখন শুধু পরপারের হাতছানির অপেক্ষা। অথচ এই বাবা-মা একসময় তাদের সন্তানদের মানুষ করতে কতই না ছোটাছুটি করেছেন। তারাই আজ সন্তানের কাছে ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতো।

সন্তানদের ঘরে জায়গা হয়নি এসব বাবা-মায়ের। অভিমান হয় সন্তানদের প্রতি কিন্তু কোনো ক্ষোভ নেই। কখনো কষ্টের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন, কখনো বা ভাবেন বেশ আছেন তারা। তবে তাদের প্রত্যাশা একটাই, কোনো একদিন সন্তানরা ভুল বুঝে তাদের ফিরিয়ে নেবে চিরচেনা সেই সংসারে। যেখানে আছে সন্তান, আত্মীয়-স্বজন সবাই। কেউ কেউ আবার মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।

সরেজমিনে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে ষাটোর্ধ্ব আক্কাস আলীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৬ সালে আমি হজ করছি। তার পরের বছর অসুস্থ হয়ে যাই। তার আগে আমি সার, সিমেন্ট ও রডের ব্যবসা করছি। এখন সেই ব্যবসা বন্ধ। যারা দেখবে তারা তো ঢাকায় চাকরি করে। আমার খোঁজ নেওয়ার সময় তাদের কোথায়! আর আমার ভাইয়েরা আছে, তারা তো তাদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। ঢাকায় আমি অনেকদিন ছিলাম। অসুস্থ হওয়ার পরও আমি ঢাকায় ছিলাম এক বছর, চট্রগ্রামে এক বছর আর দুই বছর ছিলাম উলিপুরে। সেই সময় করোনাকাল ছিল, করোনার সময় স্ত্রী মারা গেল। 

আক্কাস আলী বলেন, এখানে আসার আগে বাড়িতে একাই ছিলাম। দেখার মতো কেউ ছিল না। ছেলে-মেয়েদের কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই। ইনশাআল্লাহ আমার এখানে কেনো অসুবিধা নেই। সব তো আছে আমার। আমি চাই না কিছু। আমাকে আল্লাহ দেখবে এখন। রমজান মাস ভালোই কাটছে। ইফতারের মধ্যে তো অনেক আইটেম আর সেহরি কোনোদিন মাছ কোনোদিন গোশত কিংবা ডিম থাকে। এখানে আমার মেয়ের জামাই খোঁজ নিয়ে এই সাজু বাবাকে খবর দিয়েছে তারপর এই বাবা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। সাজু বাবা আমাকে অনেক ভালো দেখে। সে অন্যকে কেমন দেখে জানি না তবে হি ইজ এ গুড ম্যান। আমি কিন্তু ভাঙা ইংরেজিও জানি। আমি বিদেশ যাওয়ার জন্য সব ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু পরে আর যাওয়া হয়নি। বাড়ি থেকে না করল। বলল আমাদের যা আছে আমরা বিদেশ গিয়ে কী করব। অথচ আজকে আমি বিদেশ গেলে এরকম আশ্রম দুই একটা চালাতে পারতাম কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। আমার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলার ইচ্ছে করে। কিন্তু তারা তো চাকরি করে তাদের ওখানে কি আর গিয়ে থাকা যায়।

এদিকে নিজের কোনো সন্তান না থাকায় দুই মাসের শিশু সন্তানকে লালনপালন করে বড় করেছেন শান্তা বেগম। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সেই সন্তানকে সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর পর বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই মায়েরও ঠাঁই হয়েছে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে।

শান্তা বেগম বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার মেয়ে এখানে রেখে গেছে। সে আমার পালক মেয়ে। দুই মাসের বাচ্চাকে পালছিলাম এরপর ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছি। আমার একটা নাতি আছে তার জন্য মন কাঁদে যাইতে ইচ্ছা হয় কিন্তু ওরা নেয় না। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালোই ছিলাম। এখানেও ভালো আছি। কি করব ভাগ্যে যা আছে তাই তো হবে। নাতিকে খুব দেখতে ইচ্ছা হয়। একদম দুই মাসের বাচ্চাটাকে পালছি, বড় করছি, লেখাপড়া শিখিয়েছি। এরপর বিয়ে দিয়েছি অথচ এখন আমি তার কেউ না।

ওই বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম দুলাল। নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌর শহরের ডিসেন্ট টেইলার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাটিং মাস্টার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। টানাপোড়েনের সংসার হয়েও ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য স্কুল-কলেজে। স্ত্রীকে একটি স্কুলে চাকরি নিয়ে দেন। তবুও তার ঠাঁই হয়েছে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলে-মেয়ে এরা তো দেশের বাইরে থাকে। একজন থাকে জাপানে অন্যজন স্পেনে। তাদের সঙ্গে তো যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু তারা কোনো খবর নেয় না। এই সাজু বাবার কাছে আমার বোন রেখে গেছে। তখন থেকে এখানে আছি, এখানে খুব ভালো আছি।

রহিমা বেগম নামে বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা বলেন, আমার স্বামী মারা গেছে, একটা ছেলে ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপর এখানে আসছি। এখানে খুব ভালো আছি।

বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন হুমায়রা আক্তার নামে এক নারী। তিনি বলেন, এখানকার অধিকাংশ বাবা-মা অসুস্থ তাদের মধ্যে স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা বেশি। তাদেরকে আমি ফিজিওথেরাপি দিচ্ছি। তাদেরকে থেরাপি দেওয়ার কারণে তারা চলাচল করতে পারছে, আগে প্রস্রাব পায়খানা বিছানায় করত, থেরাপি দেওয়ার কারণে এখন একটু ভালো আছেন। তাদের সেবাযত্ন করে অনেক ভালো লাগছে। তাদের সঙ্গে থেকেও অনেক ভালো লাগছে। তারা অসহায় তাদের পাশে যে আমি দাঁড়াতে পারছি এটা বিশাল কিছু। যাদের সন্তান নেই তারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারেন কিন্তু যাদের সন্তান আছে তারা কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে? যারা বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মাকে রেখেছেন তারা যেন বাবা-মাকে নিয়ে যায় এবং নিজের কাছে রাখেন। নিজের বাবা-মা নিজের একটা জান্নাত, এই জান্নাতটা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।’... নন্দিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার এই গান শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে অসহায় বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু। স্বপ্ন বুননের সমাপ্তি ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন ২০১৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী সাজু কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা ইউনিয়নের সামসুল হকের ছেলে।

কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে নিজ গ্রামে কীটনাশকের ব্যবসা করে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজের জায়গায় কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজ-সংলগ্ন পাঁচটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমটির নাম দেন ‘নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রম’।

প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু বলেন, আমি বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের সেবা করার মাধ্যমে আনন্দ পাই। আমি যে বৃদ্ধ বাবা আলহাজ আক্কাস আলীকে নিয়ে এসেছি কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে। যে বাসা থেকে উনাকে নিয়ে এসেছি সেটা করুন একটা অবস্থা। উনি একটা হুইল চেয়ারে ১৭ থেকে ১৮ দিন বসে ছিলেন। হুইল চেয়ারে পায়খানা-প্রসাব সবই করতেন উনি। আর উনি যেন পায়খানা না করেন এজন্য উনাকে এক বেলা করে ভাত খেতে দিতেন। এসব দেখে উনার এক জামাইয়ের মাধ্যমে নিয়ে আসি এখানে। ওখানে নিয়ে আসার পর আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছে। ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড থেকে এক মাকে নিয়ে এসেছি। উনার কোনো সন্তান ছিল না। পালিত সন্তান ছিল, স্বামী যখন মারা যাওয়ার পর থেকে সেই সন্তানের সঙ্গে থাকতেন। তখন পালিত সন্তান উনাকে বোঝা মনে করে মারধর করে বের করে দেয়। তখন ওখান থেকে এক লোক ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি গিয়ে উনাকে নিয়ে আসি। 

তিনি আরও বলেন, আমার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের নিজ সন্তানের কাছে ফেরত দেওয়া। আমি এখন পর্যন্ত ৫৬ জন বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের কাছে ফেরত দিয়েছি। এখানে সকল বাবা-মায়ে থাকা খাওয়া কাপড় চিকিৎসা সবই ফ্রি। সবার সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠাটি চলছে। আল্লাহ কারও না কারও মাধ্যমে এই বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। রমজান উপলক্ষ্যে বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের সেহরি-ইফতার দুটোরই ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানে ৩৬ জন বৃদ্ধ বাবা-মা আছে। তার মধ্যে বিছানায় শয্যাশায়ী ৫ থেকে ৬ জন বাবা-মা রোজা থাকতে পারেন না। রোজা থাকা তাদের জন্য খুব কঠিন। রমজান মাসে এই বৃদ্ধাশ্রমের ব্যয় সবচেয়ে বেশী। কারণ তাদের পুষ্টিকর খাবার দরকার। আমি সমাজের বিত্তবানদের কাছে অনুরোধ করব এই বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করে জাকাত ফান্ডে সহায়তা করার জন্য। যখন একটা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খবর পাই, প্রাথমিকভাবে নিয়ে আসি। তারপর পরিবারের কাছে খোঁজ নিয়ে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার এখানে তিনজন বাবা-মা আছে আজ পর্যন্ত তাদের পরিবারের খোঁজ পাইনি।-ঢাকা পোস্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে