মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪, ০৩:২৩:৫১

আলুর বড় বাজার তৈরি হয়েছে সৌদি, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, নেপাল

আলুর বড় বাজার তৈরি হয়েছে সৌদি, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, নেপাল

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : প্রতিবছর সংরক্ষণের জন্য আলু রাখতে চাষিরা ধরনা দিতেন হিমাগারে। কিন্তু এবার হিমাগার কর্তৃপক্ষ চাষিদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছেন না। অথচ জমি থেকে আলু উত্তোলন প্রায় শেষের পথে। 

এখন পর্যন্ত গড়ে হিমাগারগুলোর ৩০ শতাংশ স্থান খালি রয়েছে। এ অবস্থায় এবার হিমাগারগুলো খালি থাকার আশঙ্কা করছেন হিমাগার মালিকরা। এর প্রভাব আগামীতে আলুর বাজারে পড়বে বলেও মনে করছেন তারা।

কৃষকেরা বলছেন, গত মৌসুমে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে অনেক কৃষককে লোকসান গুণতে হয়েছে। তার ওপর বেড়েছে হিমাগারের ভাড়া। বর্তমানে খেত থেকে আলু বিক্রি করে চাষিরা লাভ পাওয়ায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণে অনীহা দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে ভালো দাম পাওয়ায় বেশিরভাগ কৃষক অপরিপক্ক অবস্থায় খেত থেকেই আলু বিক্রি করেছেন। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের হিমাগার মালিকরা এবার আগেভাগেই মাঠ পর্যায়ে আলু সংগ্রহ করায় রংপুরের হিমাগার মালিকরা প্রত্যাশানুযায়ী আলু পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, রংপুর জেলায় ৩৯টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে আলুর ধারণ ক্ষমতা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৮ মেট্রিক টন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আলু সংগ্রহ শুরু হয়। এবার মার্চ মাস শেষের পথে হলেও হিমাগার মালিকরা এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সাড়া পাননি। হিমাগারগুলোতে এ পর্যন্ত ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আলু সংরক্ষণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত হিমাগারগুলোর ৩০ শতাংশ আলু সংরক্ষণের স্থান খালি রয়েছে।

হিমাগারের সংরক্ষিত আলু ব্যবসায়ী ও চাষিরা নির্দিষ্ট একটি সময়ে উত্তোলন করে তা বাজারজাত করে থাকেন। হিমাগারগুলো কাঙ্ক্ষিত আলু না পেলে বাজারের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এই সুযোগে একটি সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছে মতো আলুর দাম বাড়িয়ে দেবে, এমনটাও মনে করা হচ্ছে।

বর্তমানে রংপুরের আলু স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আলুর বড় বাজার তৈরি হয়েছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, নেপালসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানির প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হবে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

চাষিরা বলছেন, এক দশক আগেও রংপুরের স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য আলু চাষ করতেন তারা। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় অনেক সময় তারা বিপাকে পড়তেন। তবে এখন আর সেই সমস্যা নেই। লোকসানের শঙ্কা না থাকার পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন যেমন বাড়ছে, ঠিক তেমনই দামও ভালো পাচ্ছেন আলুচাষিরা।

সরেজমিন রংপুর নগরীর তামপাট, দর্শনা, মাহিগঞ্জ, সাতমাথা, বীরভদ্র বালাটারি, কলাবাড়ি, তপোধন, পশুরাম, কেরানিরহাটসহ সদরের জানকি ধাপেরহাট, পালিচড়া, পানবাড়ি, রামজীবন, শ্যামপুর, চন্দনপাট ও তিস্তা নদীবেষ্টিত রংপুরের পীরগাছার ছাওলা, শিবদেব, গাবুড়ার চর, কাউনিয়ার হারাগাছ, টেপামধুপুর, আজমখা, বুড়িরহাট, ভায়ারহাট, গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা আলু তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নারী-পুরুষ ও শিশুসহ দল বেঁধে সবাই মনের সুখে জমি থেকে আলু তুলছেন। পাইকাররা খেত থেকে আলু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার স্থানীয় বাজারে কৃষক নিজে পাইকারি ও খুচরা দুইভাবেই আলু বিক্রি করছেন।

পীরগাছার অন্নদানগর এলাকার আলুচাষি নুর ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছর থেকে আলুর উৎপাদন ভালো হচ্ছে। তবে এবার প্রত্যাশিত দামের চেয়ে চড়া দামে আলু জমিতে বিক্রি হচ্ছে। লোকসানের সম্ভাবনা এবার নেই। তবে হিমাগারে রাখার পর শেষ পর্যন্ত আলুর দাম কেমন মিলবে তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। তাই জমিতেই আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

একই উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়ার চর এলাকার জিয়াউল হক, মিজানুর রহমান ও আহসান হাবিব জানান, গত বছরের তুলনায় সার ও ডিজেলের দাম বেশি ছিল। সে সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে অনেক। তবে এবার জমিতেই আলুর দাম ভালো পাওয়ায় তারা খুশি। এবার মাঠেই তারা ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছেন। যা আলুর ইতিহাসে রেকর্ড ঘটনা।

গত মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর দাম সর্বোচ্চ ১৩-১৫ টাকা ছিল, আর উৎপাদন ব্যয় ছিল ১০-১২ টাকা। কৃষকেরা এক টাকা লাভে আলু বিক্রি করলেও মৌসুমের শেষে হিমাগার পর্যায়ে সেই আলু বিক্রি করে মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা লুটেছে কেজি প্রতি প্রায় ৪২ টাকা। কিন্তু চলতি মৌসুমে খেতেই প্রতি কেজি আলু ২৮-৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকের খরচ বাদে লাভ থাকছে দশ টাকারও বেশি। এভাবে খেতেই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় হিমাগারগুলোর আলু সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এতে মৌসুমের শেষে বাজারে আলুর দাম আবার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আলুচাষি, ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা।

কাউনিয়ার আলুচাষি আফজাল হোসেন ও নগরীর তামপাট এলাকার সোহেল মিয়া বলেন, আলুর ধরণ ভেদে ২৮ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে আলু স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন তারা। ভরা মৌসুমেও আলুর দাম ও চাহিদা দুটোই ভালো থাকায় হিমাগারে রাখার বাড়তি ঝামেলায় যাননি।

এদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় চলতি বছর এক লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার তিন হাজার ২৭৫ হেক্টর বেশি জমিতে স্থানীয় ও উফশী জাতের আলুর চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিস্তার চরাঞ্চলসহ রংপুর জেলাতেই আলু চাষ হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ১১ হাজার ৩৫৪ টন। তবে আশানুরূপ দাম ও চাহিদা থাকায় অনেক চাষি পরিপক্ব হওয়ার আগে খেতেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, গত বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আলুর মোট উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৩২ হাজার ১৫৪ টন। এবার এর চেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, অনেক জায়গাতেই এবার বেশি দাম পাওয়ায় কৃষকেরা অপরিপক্ক অবস্থায় খেতেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি জমির আলু উত্তোলন করা হয়েছে। এর বেশির ভাগ আলুই খেত থেকে বিক্রি হয়েছে।

রংপুর জেলা হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, অন্যান্য বছর মার্চে যে পরিমাণ আলু সংরক্ষণ হয়েছিল, এ বছর তার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আলু সংরক্ষণ হয়েছে। ভালো দাম পাওয়া এবং দক্ষিণাঞ্চলের হিমাগার মালিকরা এখান থেকে বেশি দামে আলু সংগ্রহ করায় রংপুরের হিমাগারগুলোর ৩০ শতাংশ স্থান এখনো ফাঁকা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রংপুর মহানগরীসহ জেলায় ৩৯টি হিমাগার রয়েছে। প্রত্যেক বছর আলু উত্তোলন হওয়ার পরেই হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। চলতি মৌসুমে চাহিদার কারণে আগাম ও অপরিপক্ব আলু জমিতেই বিক্রি করেছেন অনেক চাষি।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে