সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪, ০৯:৪৭:৪২

আবার যত হলো পেঁয়াজের কেজি

আবার যত হলো পেঁয়াজের কেজি

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ঈদের ছুটিতে কোনও কারণ ছাড়াই বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গত চার দিনে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। চার-পাঁচ দিন আগেও যা ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। 

অভিযোগ উঠেছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আবারও পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। রাজধানীতে পেঁয়াজের বড় আড়ত শ্যামবাজার থেকে এই অপচেষ্টা চলছে।

ভোক্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নড়বড়ে বিপণন ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নজরদারির অভাবে এবার ভরা মৌসুমেও পেঁয়াজের বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। আর এখন ঈদের ছুটিতে ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তারা মাঠে না থাকায় এই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সঠিকভাবে মনিটরিংও করা যাচ্ছে না।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাইকারি পর্যায়েই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। তাই খুচরা পর্যায়ে ৭০ টাকায় বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়া বাজারে পর্যাপ্ত হালি (পরিপুষ্ট) পেঁয়াজও পাওয়া যাচ্ছে না।

আড়তদাররা জানান, পাবনা ও ফরিদপুরসহ দেশের সব স্থানের মোকামেই ১ হাজার ৭০০ টাকার বস্তা গিয়ে ঠেকেছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। তাই কিছুটা বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পচনশীল পণ্য বলে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ সঠিক পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাড়তি উৎপাদনের পরও ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। আর এই ঘাটতি মেটাতেই আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু আমদানি পরিস্থিতিতে কিছু একটা সমস্যা হলেই অস্থির হয়ে ওঠে পেঁয়াজের বাজার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চীন ও ভারতের পর শুধু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশই নয়, আমদানিতেও শীর্ষে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। আর দেশে চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, ঘাটতি নয়, বরং বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে পেঁয়াজ।

সরকারি হিসাবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি অন্তত ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন। তারপরও শুধু ভারত থেকেই চলতি অর্থবছরে এরইমধ্যে ৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। কাজেই প্রশ্ন উঠেছে, উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কেন আমদানি ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। আর আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। ২০১১-১২ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২০ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ বছরে আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে হয়েছে ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া পেঁয়াজ উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ চার জেলা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও রাজশাহী।

তাদের তথ্য বলছে, বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। আর গত ৫ বছরে অষ্টম স্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মিসর ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। আরও বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, বিশ্বে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষে এখন বাংলাদেশ, আর দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র। গত পাঁচ বছর ধরে দেশে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে বছরে।

এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে বড় পেঁয়াজ রফতানিকারক দেশ নেদারল্যান্ডস। এরপরই ভারত ও চীন। বাংলাদেশ তার প্রয়োজনের প্রায় সবটাই ভারত থেকে আমদানি করে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এক আদেশে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত। এরপর দিনাজপুরের হিলি, সোনামসজিদসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসবে এমন খবরে গত সপ্তাহে ভারতীয় ও দেশি পেঁয়াজের দাম কমিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল। কিন্তু পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। তার ওপর রোজা উপলক্ষে পেঁয়াজের চাহিদা বেশি। কৃষকরাও বাড়তি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। তাই দামটা বাড়তি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানির বিষয়টি গত ১ মার্চ অনুমোদন দেয় ভারত সরকার। দেশটি পাঁচ জন পাঞ্জাবি রফতানিকারকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানির সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত করেছিল। রফতানিকারকপ্রতি ১০ হাজার টন পেঁয়াজ পাঠানোর কথা। গত ৭ মার্চের মধ্যে পেঁয়াজগুলো বাংলাদেশের বেনাপোল, ভোমরা, হিলিসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের কৃষকরা ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিট করেন। এরপর ৪ মার্চ পাঞ্জাবি রফতানিকারকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানির বিষয়টি বাতিল করে দেন ওই দেশের আদালত। ফলে বাংলাদেশে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির বিষয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। পরবর্তীতে জি টু জি ডিলিংসের মাধ্যমে সরকার টিসিবির জন্য ১৬৫০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করে, যা রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলায় টিসিবি তার নির্দিষ্ট গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করছে। তবে বাজারে এটা কোনও প্রভাবই ফেলেনি।

ফের পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে চাইলে রাজধানীর শ্যামবাজারের বিক্রেতা মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, দেশের কৃষকরা এখনও মাঠ থেকে সব পেঁয়াজ তুলে আনতে পারেনি। মাঠের সব পেঁয়াজ উঠলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। তখন দাম কমবে।

এদিকে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু আগেই জানিয়েছিলেন, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। ভারত থেকে এরইমধ্যে যে পেঁয়াজ কেনা হয়েছে সেগুলো রেলে দেশে এসে পৌঁছালে বাজার স্বাভাবিক হবে। তবে রেলে ৫০ হাজার টন নয়, এসেছে মাত্র ১৬৫০ মেট্রিক টন। তাও বাজারে নয়, টিসিবির মাধ্যমে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ কারণে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর এ ঘোষণার বিন্দুমাত্র প্রভাব বাজারে দেখা যায়নি।

তবে রমজান শেষে হয়ে যাওয়া এবং বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় পেঁয়াজের দাম কমে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু বাজারে ভারতের পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞার খবরকে পুঁজি করে এবং সবাই ঈদের আনন্দে দিন কাটানোর সুযোগে বিনা কারণে রাজধানীর বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। তারা এটাও বলার চেষ্টা করছে, সামনে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, দেশে পেঁয়াজের ব্যাপক ফলন হয়েছে। দাম বাড়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লেই দাম কমবে। বিষয়টি মনিটরিং করা হবে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে