শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৪৪:৫১

ভোটের রাজনীতির হিসাবে টালমাটাল জাতীয় পার্টি

ভোটের রাজনীতির হিসাবে টালমাটাল জাতীয় পার্টি

এনাম আবেদীন : ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণেই টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। এরশাদসহ দলটির নেতারা মনে করছেন, আগামী দিনে নির্বাচনে ফলাফল ভালো করতে হলে তাদের সরকারবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।

তা না হলে নির্বাচনে তাদের আগের চেয়েও ভোট কমে যাবে। সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বহাল থাকলে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে জাপার বর্তমান অবস্থাও টিকিয়ে রাখা যাবে না বলে আশঙ্কা তাদের।

তা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাপার মিত্র বা সমর্থক দেশগুলোও অন্তত তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাপার অবস্থান দেখতে চায়। তারা চায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের সমীকরণের মধ্যে জাপা ভারসাম্য বজায় রাখুক। অন্তত ভোটের রাজনীতির তৃতীয় শক্তি হিসেবে দলটি টিকে থাক। কারণ এটি থাকলে সরকার গঠন বা প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর দাবি, মন্ত্রিসভা ছাড়ার ব্যাপারে জাপার মিত্র ওই দেশগুলোর সমর্থন রয়েছে। তারা সবুজ সংকেত দিয়েছে। ওই সংকেতই সরকার থেকে পদত্যাগের উদ্যোগ নিতে এরশাদকে সাহস জুগিয়েছে।

গত ১৮ জানুয়ারি এরশাদ তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান এবং ২০ জানুয়ারি জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলের মহাসচিব নিযুক্ত করেন। এরশাদের নেতৃত্বে দলের এই অংশ সরকার থেকে বেরিয়ে সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার পক্ষপাতী।

তবে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সমর্থক বলে পরিচিত নেতারা মন্ত্রিসভায় থাকতে আগ্রহী। এরশাদের আমন্ত্রণে কোনো বৈঠকে তারা যোগ দিচ্ছেন না। মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে কার্যত জাপা নেতারা এখন দ্বিধাবিভক্ত।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নেয়নি। ১৫৪টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি আসনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭২.৫৯ এবং জাপা ৭.২১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জাপা ৭.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭টি আসন, ২০০১ সালের ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ৭.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪টি আসন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০.৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২টি আসন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১১.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৫টি আসন লাভ করে জাপা।

বস্তুত গত পাঁচটি নির্বাচনেই তৃতীয় শক্তি হিসেবে টিকে আছে জাপা। কিন্তু এবারই প্রথম বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রিসভায় রাখা হয়েছে জাপাকে। এতে সরকার ও বিরোধী দল এখন অনেকটাই একাকার হয়ে গেছে। ফলে জাপার ‘বিরোধীদলীয়’ চরিত্র হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনেই জাপা সুবিধা করতে পারেনি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীদের বড় অংশও মনে করছে, এভাবে চলতে থাকলে একসময় জাপা আওয়ামী লীগের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। দলের অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকবে না।

জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টি কখনোই বলেনি যে আমরা সংসদ থেকে বের হব। আমরা বলছি, এখন যেভাবে জাপা চলছে তাতে দেশের জনগণ মনে করতে পারে যে এই দলের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। এরা সরকারেরই অংশ। ফলে কর্মী-সমর্থক এবং ভোটাররা জাপার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। তাই আমরা আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে ভোট হিসাব-নিকাশ করে দেখছি। মনে করছি, সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে থাকলে অন্তত দু-তিন পার্সেন্ট ভোট বেশি পাব। মন্ত্রিত্ব সুবিধাপ্রাপ্ত তিন-চারজন ব্যক্তির জন্য পুরো দল ধ্বংস হতে পারে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে মহাজোট সরকারের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভোট কখনো ভাগ হয় না। অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ ভোট ভাগ হয়। ফলে সেদিকে খেয়াল রেখেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে।’

দলটির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারও মনে করেন, ভোটের রাজনীতি করতে চাইলে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা ছাড়া জাপার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, ‘সরকারকে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই যে সংসদে আমরা থাকব। কিন্তু সরকারে থাকলে জাপা সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। আগামী নির্বাচন যখনই হোক না কেন, ভোটের হিসাব জাপাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাপা সংসদে থাকছে। ফলে সরকার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতেও টিকে থাকতে চাই।’

জাপার নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থনের কারণে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে এরশাদ এবার বেশ কঠোর অবস্থানই নিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীকে নাখোশ করে তিনি কিছু করতে চান না। কারণ এতে তার বিপদের আশঙ্কা আছে।

ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোভাবের দিকে নজর রাখছেন তিনি। তাই বিভিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন এরশাদ। বলছেন, তার দল সংসদে থাকবে। এতে সরকারের বৈধতার কোনো সমস্যা হবে না।

অবশ্য নির্ভরযোগ্য আরেকটি সূত্র বলছে, এরশাদের এই তত্পরতাকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই জাপার মন্ত্রীদের পদত্যাগের ব্যাপারে সবুজ সংকেত তিনি এখনো দেননি। বিষয়টি ঝুলে আছে।

সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী রাজি হলেই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত জাপার সদস্যরা এমনিতেই পদত্যাগ করবেন। আর তাঁরা রাজি না হলে এক সময় না এক সময় অবশ্যই তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

আলাপকালে জাতীয় পার্টির সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, দলগতভাবে তাঁদের হিসাব হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভোটাররা কোনো দিন জাপাকে ভোট দেবেন না। কিন্তু জাপা যে ভোট পায় তা আওয়ামীবিরোধী ভোটেরই অংশ। ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে এই ভোট বাড়ানো যাবে না।

কিন্তু সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারলে বিএনপির ভোটে কিছুটা হলেও তারা ভাগ বসাতে পারবে। আর এ জন্যই ভালো ইমেজের অধিকারী জি এম কাদেরকে সামনে এনেছেন এরশাদ। তৃণমূলেও জি এম কাদেরের সমর্থন অন্য নেতাদের চেয়ে বেশি। -কালেরকণ্ঠ
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে