শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৫:৫১:২৯

এখনও আঁতকে ওঠে বাবুলের পরিবার

এখনও আঁতকে ওঠে বাবুলের পরিবার

নিউজ ডেস্ক : চা বিক্রেতা বাবুল হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আতঙ্কে রয়েছে তার পরিবার। ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না তারা। পুলিশের নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন বাবুলের স্ত্রী, সন্তান। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

শুরুতে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে বিচারের কথা বললেও এখন এ নিয়ে তাদের মুখে কোনো কথা নেই। উলটো জানিয়েছেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই এখন তারা শঙ্কিত।

গতকাল  শাহ আলী থানার গুদারাঘাটের কিংশুক এলাকায় নিহত বাবুল মাতবরের বাসায় গেলে কথা হয় তার বড় ছেলে রাজু (২৮)’র সঙ্গে। রাজু জানান, তার বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাবার হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে তারা নানা শঙ্কায় রয়েছেন। এ ঘটনায় জড়িতরা অনেক প্রভাবশালী।

রাজু বলেন, গরিব মানুষ হয়ে তাদের সঙ্গে মামলা লড়াতো কঠিন। গুজব উঠেছে, জড়িত পুলিশ সদস্যরা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে নিহতের পরিবারের সদস্যদের। সমঝোতার প্রস্তাবের পরই রহস্যজনক বক্তব্য দিচ্ছেন নিহতের স্বজনরা।

বাবুল হত্যাকাণ্ডে মামলা করার পর বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানান বাবুলের স্বজনরা। ঘটনার পরদিন ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সকালে বাবুলের শ্যালিকা শামসুন্নাহারকে ফোনে হুমকি দেন একটি নারী সংগঠনের এক নেত্রী। মামলা তুলে না নিলে পরিণাম ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দেন তিনি।

শামসুন্নাহার জানান, ঘটনার পরপর ৩রা ফেব্রুয়ারি রাতেই পুলিশের সোর্স আইয়ূবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু শাহ আলী থানা হাজত থেকে পালিয়ে যায় সে। ওই দিন কর্তব্যরত কর্মকর্তা ছিলেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নেওয়াজ। বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, থানা থেকে কোনো আসামি পালিয়ে যায়নি। এ বিষয় নিয়ে তিনি বিপদে আছেন বলে জানান ওই এসআই।

নিহতের ছেলে রাজু জানান, পুলিশের সোর্সরা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এজন্য ওই এলাকার মাদক বিক্রেতা পারুল বেগম ওরফে পারুলিকে দায়ী করেন রাজু। বাবুল মতবরের বাসার পাশেই পারুলের বাসা। গাঁজা বিক্রিকে কেন্দ্র করেই দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত। রাজু  জানান, ৩রা ফেব্রুয়ারি গুদারাঘাট এলাকা থেকে গাঁজাসহ পারুলের স্বামী আজিজুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এতে বাবুল মাতবরের ওপর ক্ষিপ্ত হন পারুল। সরাসরি বাবুলকে দায়ী করে হুমকি দেন পারুল। ও

ই সময়ে পারুল বলেছিলেন, তুই আমার স্বামীকে ধরিয়ে দিছস, তোকে ছাড়ব না। তোকে আমি দেখে নেব। তারপর সবার সামনেই পারুল ফোনে কথা বলেন পুলিশের সোর্স দেলোয়ারের সঙ্গে। রাজু জানান, তিনি নিজে শুনেছেন পারুল তাকে বলেছে বাবুল আমার স্বামীকে ধরাইয়া দিছে। এর একটা ব্যবস্থা নিতে অইবো। এর শেষ কোথায় আমি দেখে নেব।

রাজু বুঝতে পারেন তার বাবাকে একটা বিপদে ফেলে দিচ্ছে পারুল। এ সময় পারুলের হাতে ধরে রাজু বলেছিলেন, বিকালে এর একটা মীমাংসা করব। আমার বাবা চা বিক্রি করে খান। তাকে হয়রানি করবেন না।

কিন্তু রাজুর কথা গুরুত্ব দেননি পারুলি। তারপরেই রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাবুলকে আগুনে পুড়ানো হয়। কিংশুট সিটির আট নম্বর সড়কের এইচ ব্লকের ৬/সি নম্বর বাড়ির রাস্তার পাশেই বাবুলের চায়ের দোকান। এখনও দোকানে একটি সোকেস, পানির জার পড়ে আছে। ওই দোকানের পাশে একটু ভেতরে আবদুল কুদ্দুসের চায়ের দোকান। আবদুল কুদ্দুস জানান, পুলিশের গাড়িটি তার দোকানের সামনেই থামানো ছিল। গাড়ি এখানে থামানোর কিছু সময় পরে চিৎকারের শব্দ শুনেন তিনি। এর মধ্যেই আগুনে দগ্ধ বাবুল মাতব্বরকে দৌড়াতে দেখেন তিনি। বাবুল চিৎকার করছিলেন। তার পেছনে ছিল কয়েক পুলিশ।

একইভাবে প্রত্যক্ষদর্শী ওই দোকানের পাশের বাসার বাসিন্দা জাহানারা জানান, চিৎকার শুনে বের হন তিনিসহ কয়েক জন। দোকানে তখন বাবুলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিল কয়েক পুলিশ। এর মধ্যেই লাথি মেরে বাবুলকে কেরোসিনের স্টোভ ফেলে দেয় দেলোয়ার। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে আগুন ধরে যায়। দোকানে পানি ছিল কিন্তু পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দেয়নি। বাবুল তখন মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন।

বাবুলের ছেলে রাজু জানান, খবর পেয়ে তারা যখন ছুটে যান তখন বাবুল চিৎকার করে বলেছেন, দেলোয়ারকে ধর। ওরা আমার শরীরে আগুন দিয়েছে। রাজু বলেন, বাবুলের কাছে চাঁদা চেয়েছিল তারা। এ নিয়েই বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে বাবুলকে আগুনে দগ্ধ করা হয়। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় মাদক বিক্রেতা পারুল, পুলিশের সোর্স দেলোয়ার ও আইয়ুবকে দায়ী করেন বাবুলের পরিবারের সদস্যরা। রহস্যজনকভাবে জড়িত পুলিশ সদস্যদের এড়িয়ে যেতে চান তারা। সূত্রমতে, বাবুলের বড় ছেলে রাজু একটি হত্যা মামলার আসামি। বাবুল হত্যায় পুলিশকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য না দেয়ার শর্তে ওই পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে চার লাখ টাকা ও রাজুকে মামলা থেকে খালাস দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।

বাবুলের শ্যালিকা শামসুন্নাহারের মাধ্যমে এই প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবের পর থেকেই বাবুলের স্ত্রী লাকী আক্তার ও শ্যালিকা শামসুন্নাহারের বক্তব্য পাল্টে গেছে। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তারা। এ বিষয়ে শামসুন্নাহার বলেন, টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করার প্রশ্নই উঠে না। পুলিশ জড়িত কি-না তা তদন্তে বের হবে বলে জানান শামসুন্নাহার।

নিহত বাবুলের ছেলে রাজুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রসঙ্গে জানা গেছে, বাসার পাশে বালুর মাঠে একটি দোকান ছিল রাজুর। ওই এলাকায় প্রায় সাত মাস আগে পুলিশের সোর্স জসিমের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় জসিমের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় রাজুসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়।

এ বিষয়ে রাজু জানান, দোকানের পাওনা টাকা নিয়ে হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে ঝগড়া হয়েছিল জসিমের সঙ্গে। এ ঘটনার জের ধরে সন্দেহমূলক আসামি করা হয় তাকে। এতে তিনি জড়িত না। জড়িতরা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে কিন্তু কেউ তার নাম বলেনি। এ মামলায় বর্তমানে জামিনে রয়েছেন রাজু।

রাজু জানান, তার বাবা বাবুলকে হত্যার আগেও বিভিন্ন সময়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতো পারুল, আইয়ুব ও দেলোয়ার। বাসার পাশে গাঁজা বিক্রির প্রতিবাদ করার কারণেই তাকে হয়রানি করতো তারা। হয়রানি থেকে রক্ষার জন্য গত বছরের ১৬ই আগস্ট পুলিশের মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার বরাবর লিখিত আবেদন করেছিলেন বাবুল।

বাবুল হত্যার ঘটনায় পুলিশের সোর্সসহ সাত জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহত বাবুলের মেয়ে রোকসানা। মামলাটি গত সোমবার গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে পুলিশের মিরপুর জোনের তদন্ত কমিটি গতকাল প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

তার আগে গত রোববার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে কর্তব্যপালনে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে শাহ আলী থানার তৎকালীন ওসি একেএম শাহীনকে প্রত্যাহার, এসআই মমিনুর রহমান খান, এসআই নিয়াজ উদ্দিন মোল্লা, এএসআই দেবেন্দ্র নাথকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (গণমাধ্যম) উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে