মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ১২:৫৩:১৫

তৃণমূলে জোর প্রস্তুতি বিএনপির

তৃণমূলে জোর প্রস্তুতি বিএনপির

কাফি কামাল : আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের পরিবেশ এবং ফলাফল নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। নানা বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।

একইসঙ্গে দলের প্রার্থী মনোনয়নে এবার স্থানীয় নেতাদের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তারই আলোকে দলের তরফে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জন্য ঘোষণা করা হয় একটি নীতিমালা। ১২ই ফেব্রুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি প্রকাশ করার পর ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে।

এদিকে দলের তরফে মনোনয়নের নীতিমালা ঘোষণার পর উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সুপারিশ জোগাড় করতে দৌড়ঝাঁপ করছে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি দলের তৃণমূলের সমর্থন জোগাতে চলছে তাদের লবিং-তদবির। চলমান সাংগঠনিক পুনর্গঠন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বৈঠকেও ইউপি নির্বাচন ইস্যুতে আলোচনা সেরে নিচ্ছে তৃণমূল নেতারা।

তারা সুপারিশের আগে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আমলনামা বিশ্লেষণ করছেন। কিছু কিছু এলাকা থেকে সুপারিশকৃত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা জমা হচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। জোটের শরিক দলগুলোও তাদের নেতাকর্মীদের মাঠ গোছানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। কয়েকটি শরিক দলের শীর্ষ নেতারা অবস্থান করছেন এলাকায়।

তবে পৌর নির্বাচনের মতো ইউপি নির্বাচন জোটবন্ধ হবে না দলীয় ভিত্তিতে সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে শরিক দলগুলো। তবে ইউপি নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করে নির্দেশনার জন্য গত রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন শরিক দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা।

একটি সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আজ একত্রিত হচ্ছেন জোটের মহাসচিবরা। সেখানে ইউপি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা। বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, পৌর নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যয়নের দায়িত্বে যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান থাকলেও এবার ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ দায়িত্ব পালন করবেন। মনোনয়নপত্র দাখিলের অন্তত সাতদিন আগে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর নাম, ভোটার আইডি নম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে আগামী ১৯শে মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে ২২শে মার্চ ইউপি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে কাউন্সিল ও ইউপি নির্বাচন দুই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বিএনপি। একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত করা এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞের বিষয়। নির্বাচন পরিচালনাও এক ব্যাপক কর্মকাণ্ড।

উভয় বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে ব্যস্ত সময় পার করতে হবে। বিএনপি কি ইউপি নির্বাচনে অংশ নেবে বা কাউন্সিলের দুই মধ্যে অংশ নিতে পারবে? রাজনৈতিক মহলে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন, শুরু হয় আলোচনা। তবে ১২ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ।

সেদিন দিন তিনি ইউপি নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে নানা শঙ্কা, সংশয় প্রকাশ করলেও অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। পরে এক বিবৃতিতে দলের তরফে ঘোষিত নীতিমালায় বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির মনোনয়ন পেতে হলে দলের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটির পাঁচজন নেতার যৌথ সুপারিশ লাগবে।

সে পাঁচজন হলেন- উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক। তবে সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে কেউ না থাকলে বিকল্প পদবীধারীর কথাও উল্লেখ করে দেয়া হয়। বলা হয়, তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রার্থীর নাম অনুমোদন করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

এদিকে রোববার নির্বাচনে কমিশনে যান বিএনপি প্রতিনিধি দল। সেখানে তারা একটি চিঠি দিয়ে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির আপত্তির কথা জানান। এতে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন করে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

তবে এ সংশয়ের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে রিজভী আহমেদ গতকাল বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আমরা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করেছি সেটাই নির্বাচন কমিশনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেছি। দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির আপত্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, নির্বাচন ওয়াচ গ্রুপসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পর্কে ইতিমধ্যে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

তারা বলেছেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জনসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বিএনপিও বিশ্বাস করে- দলীয় প্রতীকে ইউপিসহ যে কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচন তৃণমূলে সামাজিক বন্ধন বিনষ্ট করবে। তারপরও গণতন্ত্রের এই দুঃসময়ে সরকারের নানামুখী জুলুম, ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতির সম্ভাবনার মধ্যেও এই ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের সংকুচিত পরিসরকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

ভয়াবহ দমন পীড়ন ও ভোটারদের ভোট প্রদানের অধিকার কেড়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেই ক্ষুদ্র পরিসর সম্প্রসারিত করার আন্দোলন হিসেবে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বিএনপি। ইউপি নির্বাচন নিয়ে যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক। এবার সম্ভবত দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবই মনোনয়ন প্রত্যয়ন করবেন।

নির্বাচন কমিশনে সেটা জানাতে হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিব সই করলে নির্বাচন কমিশনে জানাতে হয় না। তাদের দু’জনের বাইরে অন্য কেউ সে দায়িত্ব পালন করলে তখন চেয়ারপারসন বা মহাসচিবকে তা অবহিত করতে হয়।

এদিকে ইউপি নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য গতরাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জোটের শরিক দল বিজেপি সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। তিনি বলেন, আমাদের অনেক প্রার্থী রয়েছে। তারা নির্বাচন করতে আগ্রহী এবং এ জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। কিন্তু এখনও জানি না, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না বা কিভাবে যাবে। দলীয় প্রতীকে যাবো না জোটের প্রধান দল বিএনপির প্রতীকে যাবো। এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা ও শীর্ষ নেতার নির্দেশনার জন্যই রাতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো।

ব্যারিস্টার পার্থ বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। কারণ সবসময় ফলাফলকে মুখ্য বিবেচনা করা উচিত নয়। ফলাফল যাই হোক, নির্বাচনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারবো বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

গতরাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতিক। এর আগে গতকাল বিকালে তিনি বলেন, আমরা ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে এবং এ জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছি। এখন জোটের প্রধান দল বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় আছি।

এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত হয়নি সেটা দলীয়ভাবে না জোটগতভাবে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, জয়পুরহাট, নেত্রকোনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর ও ঝালকাঠিতে আমাদের দলের শক্ত অবস্থান রয়েছে। সেখান থেকে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা যোগাযোগ করছেন। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হলেও তাদের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

খেলাফত মজলিশের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে আসন্ন ইউপি নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না। এটা জেনেও আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, জোটগতভাবে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাপ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলটির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি গত তিন সপ্তাহ ধরে নিজ জেলা নীলফামারীতে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী সম্ভাব্য ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া জানান, নীলফামারীতে দলটির শক্ত অবস্থান রয়েছে। তৃণমূলে দলের এ অবস্থান সুসংহত রাখতে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। সে অনুযায়ী চেয়ারপারসন ও মহাসচিব মিলে এলাকায় কাজ করছেন। মানবজমিন
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে