বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৭:৪৪:১১

জানেন কেন সেই দিন ‘আত্মহত্যা’ করতে চেয়েছিলেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ?

জানেন কেন সেই দিন ‘আত্মহত্যা’ করতে চেয়েছিলেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ?

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক বছর আগে দেশের চাকরি-বাজারের দুরবস্থা নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আত্মহত্যার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার কোন পরিবর্তন না হওয়ায় সেই পোস্ট বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে আবারও নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করেছেন তিনি।

তিনি লিখেছেন, ‘আমি একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে গত বছর (২৩ আগস্ট ২০২৩) চাকরি প্রার্থীদের কষ্ট ও হতাশা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একজন চাকরিপ্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ কখনোই বুঝতে পারবে না যে, এই যন্ত্রণার মাত্রা কতটা অসহনীয়।

‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, পিএসসির সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ কার্যক্রম চালু করুন। এছাড়া, বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে প্রহসনমূলক আবেদন ফি বাতিল করুন।’

এক বছর আগের দেয়া পোস্টে হাসনাত লিখেছিলেন, ‘আমি যেকোনো সময় আত্মহত্যা করতে পারি। ঠিক যতগুলো কারণে আমার বন্ধু মনজু গতকাল (২২ আগস্ট ২০২৩) এসএম হলে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার জন্য আমার কাছেও ঠিক ততোগুলো কারণ রয়েছে। উদ্যাম তারুণ্য পেরোনো প্রান্তিক বয়সে এসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির নির্জনতায় বসে মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমি এখন পরিচয়হীন পরিচর্যাহীন বেকার। আমি না ছাত্র, না পেশাজীবী, না কারো দায়িত্ব নেয়ার যোগ্যতা আমার এখনও হয়েছে, না আমার দায়িত্ব নিতে সমাজের আর আগ্রহ রয়েছে।

‘অর্থাভাবে ভীষণভাবে জর্জরিত। আত্মবিশ্বাস ভয়াবহ তলানিতে। মানুষিকভাবেও ভীষণ বিপর্যস্ত। কাটছাট করে এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে ৭০ টাকায় সারাদিন পার করতে হয়। “কড়া” হয়েছে বলে ক্যান্টিন বয় যখন গরু দিতে চায়, টাকা বাঁচাতে শুষ্ক হাসি দিয়ে ডায়েটে থাকার অজুহাতে সবজি নিয়ে আসতে বলতে হয়। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে মাঝে মাঝে মাছ কিংবা মাংসের একটু ঝোলের জন্য ক্যান্টিন বয়কে বলতে গিয়েও থেমে যাই। ডিম-আলু-ডাল জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমান বাজার দরে এগুলোও এখন সাধ্যের বাইরে। খাবার খরচ, চাকরির এপ্লিকেশন ফি, পকেট খরচ, প্রিলি-রিটেনের বইয়ের দাম নিয়ে ভাবতে ভাবতে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। রাত গভীর হয়, কাটাবন মসজিদের ফজরের আযান কানে আসে, মাস বাড়তে থাকে। এদিকে পাল্লা দিয়ে মুখে রুচি আর পেটে ক্ষুধা দুইটাই বাড়তে থাকে। শুনেছি অভাবে নাকি মানুষের ক্ষুধাও বাড়ে!’
 
হাসনাত লিখেন, ‘যেসব বন্ধু-বান্ধব ম্যাট্রিকের পর পড়াশোনা না করে বিদেশে চলে গিয়েছে, তারা এখন প্রতিষ্ঠিত। ঘর-সংসার করে থীতু হচ্ছে। বাপ-মাকে হজে পাঠাচ্ছে। এলাকায় জায়গাজমি কিনে তেজারত বাড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ফোন উঠিয়ে তাদের কাছে টাকা-পয়সা চাওয়ার কথা মনে হয়। দু-একবার ফোন হাতে নিয়েও রেখে দিই। আত্মমর্যাদার বায়বীয় চাদরে মোড়ানো লাজুকতা ভুলে গিয়ে যখন বন্ধুদের কাছে ফোন দিইও, অপরপ্রান্তের বন্ধু থেকে নিজের সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পাই, তা শুনলে যে উদ্দেশ্যে ফোন দিয়েছি, সেই প্রসঙ্গ আর উঠাতে সাহস হয় না। সেসব বন্ধু-বান্ধব ধরেই নিয়েছে দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে আমরা এখন অর্থ, বৈভব ও জাগতিক সম্মানে বিপুলভাবে পরিতৃপ্ত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সাথে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নের কোন মিল নেই উল্লেখ করে হাসনাত লিখেন, ‘পরিস্থিতি হয়েছে এমন, পকেটে নাই টাকা, কিন্তু চারদিক থেকে অস্বস্তিকর সম্মানের ছড়াছড়ি। আসলে ফাঁকা পকেটে সম্মান বেশি হয়ে গেলে সেটা বদহজম হয়ে যায়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর যেসব পড়িয়েছে, আর এখন চাকরির পরীক্ষায় আমাদের থেকে যা জানতে চাওয়া হচ্ছে -- সেসবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

‘একটার পর একটা শুক্রবার আসে, চাকরির পরীক্ষা আসে, শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সিট পাল্টায়, পকেটের এডমিট কার্ডটা পাল্টায়, কিন্তু এমসিকিউর গোল্লার বৃত্তে আটকে থাকা কপালটা আর কলমের খোঁচায় পাল্টায় না। কপাল কবে পাল্টাবে -- সে প্রশ্নের উত্তরে আমার জীবনসন্ধানী মন এখন নিশ্চুপ।’

ঈদের মধ্যেও বাড়ি যেতে না পারার হতাশার কথা জানিয়ে এ সমন্বয়ক লিখেন, ‘কখন কী হয়, কিছুই বলা যায় না। চলমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে ক্রমশ হাতাশার নিঃশ্বাস ফেলতে হয়! পরিবার, সমাজ ও আশপাশের মানুষের প্রশ্ন -- এখন কি করো? আর কবে? আর কতদিন?” প্রশ্নের উত্তর এড়াতে ঈদের মধ্যেও হলে থেকে যেতে হয়। পরিচিত মানুষের ফোন কল এড়িয়ে যেতে পারলে মনটা স্বস্তিতে ভরে ওঠে।

‘নিজের কষ্ট, অসন্তোষ, রাগ কিংবা ভালোবাসা -- আমরা কাউকে কিছুই এখন বলতে পারছি না। মুখবুঁজে সমুদ্র গিলতে হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে পরিবার, সমাজ ও নিজের প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। এতোদিন উড়তে থাকা আমি এবং আমার স্বপ্ন, এই সংকটে আটকে পড়ে ধুলোমলিন বেশে নিয়তির মুখোমুখি হতে চলেছে। লাগামছাড়া ব্যর্থতা ও সংকটের ত্রাহি ত্রাহি রবই শুধু নয়, আমাদের এখন সবার সামনে নিদারুণ উপহাসের পাত্রও হতে হচ্ছে। কাছে আসার “রঙিন দিনেরা” ক্রমাগত দূরে যাওয়ার ধূসর বিবর্ণ গল্পে পরিণত হচ্ছে।
 
‘আর ঠিক তখন, ঠিক তখনই, জীবন থেকে মৃত্যুই পরম কাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়। ঠিক তখনই হাসনাতরা মনজু কিংবা রুপা কর্মকার হতে চায়। মনজু যেমন শরতের শিশিরের মতো রোদ উঠার আগেই নিঃশব্দে মিলিয়ে গিয়েছে। মনে হয়, ঠিক সেভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃতে মিলিয়ে যাই। এক-পা, দু-পা করে মিলিয়ে যাওয়ার পথ ধরতে ইচ্ছে হয়। তবে, কোথায় যেনো বাধা পড়ে যাই!’
 
এ সময় সত্যজিত রায়ের অপুর সংসার সিনেমার উদাহারণ টেনে হাসনাত লিখেন, ‘ওই মুভিতে অপুকে বলতে শোনা যায়, তার মধ্যে মহৎ কিছু একটা করার ক্ষমতা আছে, সম্ভাবনা আছে; কিন্তু সেটা সে পারছে না। আবার এই না পারাটাও শেষ কথা নয়, ট্র্যাজিডিও নয়। সে মহৎ কিছু পারছে না, তার দারিদ্র্য যাচ্ছে না, তার অভাব মিটছে না; কিন্তু এত কিছুর পরেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না। সে পালাচ্ছে না, স্কিপ করছে না, মনজুর মতো আত্মহনন করছে না বরং সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে -- বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, বাঁচার মধ্যেই আনন্দ। He wants to live.’

এই পয়েন্টটাতে এসে আর জীবনবিমুখ হতে পারি না জানিয়ে তিনি আরও লিখেন, ‘আসলেই বেঁচে থাকতে পারছি এটাই তো সার্থকতা। একটা থেঁতলে যাওয়া ব্যাঙও মাটির সাথে অর্ধেক লেপ্টে থাকা দেহটা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লাফানোর চেষ্টা করে। দুষ্টু ছেলের হাতে ধরা পড়ে পাখা হারানো লাল ফড়িংটাও চেষ্টা করে নীল আকাশে আবার উড়ে বেড়ানোর। আর আমি তো মানুষ, শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। ভয় কী, আবার শুরু করবো। সমাজ, পরিবার ও আশপাশের মানুষের প্রত্যাশায় বেঁচে থাকা বন্ধ করে, নিজের আশার ওপর নির্ভর করে বাঁচবো। আত্মহত্যা করতে জীবন আমাকে হয়তো শতশত যৌক্তিক কারণ দেখাচ্ছে; কিন্তু আমি জীবনকে শুধু একটা কারণ দেখিয়েই বেঁচে থাকবো। আর সেটা হলো 'আশা'। থেমে না গিয়ে এই সম্বলটুকু নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'Every man dies but not everyman lives'. মৃত্যুকে দেখিয়ে দিবো আমি জীবন থেকে পালিয়ে যাইনি, যাঁরা বেঁচেছে, আমি তাদের একজন।

‘অজানা এক লুপ্ত নক্ষত্রের মতো হারিয়ে যাওয়ার আগে, ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত সব বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে আমাদের স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস এ আমাদের সুস্থির থাকতে হবে। দীর্ঘ খরা কাটিয়েও আবার যেমন প্রকৃতিতে বৃষ্টি নামে, শুকিয়ে যাওয়া নদীতেও আবার যেমন ঢেউ ওঠে, আমরাও জানি, কষ্ট পেতে পেতে কোন একদিন আবার আমরা সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে সুস্মিত শিশিরের মতো সবার মাঝে আবারও প্রকাশিত হবো স্বতেজে।

‘তাই সমাজের কাছে অনুরোধ, অপেক্ষা করুন। আমাদের সময় দিন। আমরা যা, আমাদের সেভাবেই মেনে নিন। “কে কী হয়েছে” এসব উদাহরণ টেনে এনে, “আমাদের কী হতে হবে” এইসব বলা বন্ধ করুন। পাশাপাশি, আর কোনো হাসনাতকে যেনো তেলহীন প্রদীপের মতো ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে মনজু না হতে হয় সেজন্য দেখা হলেই “এখন কি করো” প্রশ্নটা না করে, “এখন কেমন আছো?” এ প্রশ্নটা করুন। কারণ, রাষ্ট্রের এই অসম ও অপ্রতুল আয়োজনে আমরা ভালো নেই।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে