শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৫:০৭:৫৭

‘মা আমি বাঁচব না, না খেয়েই মারা যাব’

‘মা আমি বাঁচব না, না খেয়েই মারা যাব’

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ‘বাবা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রায়ই বড় ছেলেকে তিনি দা-বঁটি নিয়ে ধাওয়া করতেন। তাই বাড়িতে থাকা হয়নি বেশি। শিশুবেলা কেটেছে নানার বাড়িতে। 

চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখাও করেছিল। কিন্তু পরিবারের অনটন ঘোচাতে ১২ বছর বয়সেই কাজের সন্ধানে সে পাড়ি দিয়েছিল ঢাকায়। সেখানে দার কাজও জোটে। থাই গ্লাসের দোকানে কাজ শুরু করা 

সেই ছোট্ট পারভেজের বয়স দাঁড়ায় ২২ বছরে। তিনি সংসারের হাল ধরেছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। এখন তো আর ছেলেটি নেই, সংসারের হাল ধরার মতো কেউই রইল না। কারণ মাথায় গুলিবিদ্ধ পারভেজ শহিদ হয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।’

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধন্যপুর গ্রামের মিন্নত আলী হাজি বাড়িতে গেলে পারভেজ হোসেনের স্বজনরা এভাবেই তার জীবনের কথাগুলো জানান। শহিদ পারভেজ ছিলেন ওই বাড়ির নবী উল্যা ও ফাতেমা বেগম দম্পতির বড় ছেলে।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজের মাথায় গুলি লাগে। এরপর ১ মাস ৮ দিন চিকিৎসাধীন থেকে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তিনি মারা যান। তিনি মিরপুর ১০ নম্বরে সেনপাড়া থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন।

ঘটনার একদিন আগে পারভেজের সঙ্গে তার মা ফাতেমা বেগমের কথা হয়েছিল। ছেলে তখন মাকে বলেছিল, ‘মা আমি বাঁচব না, না খেয়েই মারা যাব।’ প্রত্যুত্তরে মা বলেছিলেন, ‘বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। মা যদি এক মুঠো খেতে পারি, তুইও পারবি।’

তবে না খেয়ে মারা না গেলেও গুলি খেয়ে মারা গেলেন পারভেজ। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারলেন না। সেই ছোটবেলা থেকেই যে পরিবারকে বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিল। সেই পারভেজ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।

পারভেজের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে স্ত্রী রূপা আক্তারকে নিয়ে পারভেজ ভাড়া বাসায় থাকত। আন্দোলনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। তার বাসায় পর্যাপ্ত খাবারও ছিল না। এজন্য আমাকে বলেছে মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাব মনে হচ্ছে। আমি চলে আসতে বলেছি, কিন্তু সে আর আসেনি। তার লাশ এসেছে বাড়িতে। পারভেজের স্ত্রী তার বাবার বাড়ি পাবনায় চলে গেছে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন এক ডাক্তার ফোন দিয়ে বলছে, মোবাইলের মালিক কে হয় আমার? আমি বলেছি, আমার ছেলে হয়। বলেছে নাম কী, বললাম পারভেজ। তখন বলেছে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমার ছেলে কথা বলতে পারে না। প্রথম থেকেই একই অবস্থা, মাঝেমধ্যে হাতের ইশারা দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করত, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।

তিনি বলেন, পারভেজ ছোটবেলা থেকেই সংসার খরচ দিত। ছেলেটি পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। তবে তার বোনদের পড়ালেখার খরচও বহন করত সে। আজ তো সে-ই নেই। আগে তো সংসার খরচ পারভেজ চালাত। সামনে চালাবে কে? তার বাবার সামর্থ্য নেই কোনো কাজ করার। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।

ঢাকায় হাসপাতালে পারভেজকে দেখতে গিয়েছিল তার বোন নাহিদা আক্তার। কিন্তু শেষবারের জন্যও ভাইয়ের সঙ্গে একটি কথাও বলতে পারেনি। তার দাবি ভাই তার সঙ্গে রাগ করেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। 

তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে গিয়েছি। ভাইকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। সেখানে থাকা লোকজনকে পরিচয় দিলে তারা আমাকে ভাইয়ের কাছে যেতে দেয়। ভাই প্রথমে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। পরে চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে হাতে লাগানো স্যালাইনসহ বিভিন্ন ডাক্তারি সরঞ্জাম খুলতে ইশারা করে। খুলে না দেওয়ায় একপর্যায়ে ভাই আমার ওপর রাগ হয়ে যায়। পরে কর্তৃপক্ষ আমাকে বের হয়ে যেতে বলে।

ভাইয়ের কথা মনে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ে নাহিদার। এরপর আর কোনো জবাব দিতে পারেনি সে।

মানসিক সমস্যা থাকায় প্রায়ই ধাওয়া করা ছেলেটির জন্য এখন পরান পোড়ে বাবা নবী উল্যার। তিনি বলেন, হঠাৎ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, অবশ্যই ছেলেটার জন্য মন টানে। কোরবানির ঈদের সময় বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে থাকলে তো আর ছেলেটা এভাবে মারা যেত না।

পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন বলেন, পারভেজই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার বিকাশেই বাড়ির জন্য সব সময় টাকা পাঠাত। বাড়িতে এলে আমার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাত। তাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না।

গ্রাম পুলিশ সাইফুল ইসলাম বলেন, পারভেজই সংসারের খরচ চালাতো। তার বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রায়ই ঘরে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। এলাকার মানুষ তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা করে। 

পারভেজের এক বোনকে এলাকার সবাই উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এখনো তার একটি বোন অবিবাহিত রয়েছে। এছাড়া ছোট দুটি শিশু রয়েছে। তাদের সংসারে হাল ধরার কেউ নেই। এখন অনেকেই তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের সংসার চালানোর মতো কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কামারহাট ঈদগাহ মাঠে পারভেজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের পারিবারিক কবরস্থান বন্যার পানিতে ডুবে ছিল। তাই পার্শ্ববর্তী আরেক জায়গায় তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে। পারভেজের মৃত্যু সনদ ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় থেকে এনে তার মাকে বুঝিয়ে দিয়েছি।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে