রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১:৩৬:০৪

সামনে বিয়ের মৌসুম, স্বর্ণের দাম নিয়ে তাঁতিবাজার ব্যবসায়ীর ভবিষ্যদ্বাণী

সামনে বিয়ের মৌসুম, স্বর্ণের দাম নিয়ে তাঁতিবাজার ব্যবসায়ীর ভবিষ্যদ্বাণী

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : দেশে শীতকাল তথা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিকে ধরা হয় বিয়ের মৌসুম হিসেবে। এই সময়টাতে স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু এবার চিত্রটা হতে পারে অন্যরকম। হু হু করে বাড়তে থাকা দামের কারণে মুশকিলে পড়েছেন স্বর্ণের ক্রেতা-বিক্রেতারা। প্রশ্ন উঠছে আসন্ন বিয়ের মৌসুমে কেমন যাবে এই ব্যবসা?

উপমহাদেশে বিয়ের গহনা হিসেবে প্রাচুর্যের প্রতীক স্বর্ণ। স্বর্ণের গহনা ছাড়া বর্তমান সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না! মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের বিয়েতেও কনের অলঙ্কার হিসেবে নূন্যতম দুয়েক ভরি গহনা কেনার রেওয়াজ আছে।

তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামে দৈনন্দিন বাজেট মেলাতে হিমশিম অবস্থা সাধারণ মানুষের, তারওপর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে স্বর্ণের দাম। এ অবস্থায় গহনা কেনার বিলাসিতায় কতজন করতে পরবেন সেটা নিয়ে মাথাব্যথা স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) বলছে, স্বর্ণের বাড়তি দাম চলে যাচ্ছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ফলে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বিয়ের বাজেটে।

সমাপ্তি সাহার (২৮) বিয়ে আগামী ডিসেম্বরে। কিন্তু কেনাকাটা করতে গিয়ে স্বর্ণের দাম শুনে মাথায় হাত পুরান ঢাকার এই বাসিন্দার। বিয়েতে গহনার পরিকল্পনা নিয়ে সময় সংবাদকে সমাপ্তি বলেন, ‌‌‘দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে স্বর্ণ ছাড়াই বিয়ে করতে হবে। না হলে মাটির বা কাঠের গহনা তো আছেই! এতে টাকাও বাঁচবে, আবার ফ্যাশনের দিক দিয়ে ইউনিক কিছুও করা হবে।’

তাঁতিবাজার স্বর্ণের দোকানে তপন মল্লিক (৫৬) নামে এক ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। বলেন, ‘মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে বর্তমান সময়ে এসে বিয়ের ক্ষেত্রে কনেকে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ ভরি স্বর্ণ দেয়া লাগে।’

আগামী ফেব্রুয়ারিতে মেয়ের বিয়ে। বর্তমানে স্বর্ণের ভরি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার ওপরে। এতে মজুরিসহ এক ভরি স্বর্ণের গহনার দাম পড়ে প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো। এতো টাকা গহনার পেছনে খরচ করলে বাকি অনুষ্ঠান কীভাবে করবেন তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনি।

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সারা বছরের বিক্রির একটি বড় অংশ হয় নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে, মানে বিয়ের মৌসুমে। কিন্তু এবার বেচাবিক্রি প্রত্যাশার অর্ধেকও পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

রাজধানীর তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুরঞ্জন পাল (৬৫) জানান, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে এরই মধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে। সামনে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কমে গেছে বিক্রি। আগামীতে দাম বাড়লে ক্রেতারা স্বর্ণ কেনাই বাদ দিবেন।

আরেক ব্যবসায়ী প্রতুল পাল (৪৫) বলেন, ‘শুধু স্বর্ণ কিনলেই তো আর হবে না। এর ওপর যুক্ত হবে ভ্যাট এবং শ্রমিকের মজুরি। ৬ শতাংশ মজুরি এবং ৫ শতাংশ ভ্যাট; সব মিলিয়ে মূল দামের ওপর বাড়তি ১১ শতাংশ দাম যোগ হবে। এতে স্বর্ণের ভরি হিসাব করে যারা গহনা কিনতে আসছেন মূল দাম তার থেকেও দাঁড়াচ্ছে অনেক বেশি।’

বাজুসের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রতিভরি ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫১ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৯৮ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৮ হাজার ৮৬০ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৮৯ হাজার ২১৮ টাকা।

পুরান ঢাকার আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী পিন্টু দাস (৫৫) জানান, বর্তমানে বাজারে স্বর্ণের দাম বেশ চড়া। ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে সীতাহারজাতীয় গহনার দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় শুরু হয়। বিয়ের জন্য সীতাহারের পাশাপাশি হাতের কাঁকন, গলার চেইন, মাথার টিকলি-টোপর, আঙুলের আংটি কেনেন গ্রাহকরা। সব মিলিয়ে স্বর্ণের গহনা বাবদ অন্তত ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়।

বিয়ের মৌসুমে কাজের চাপ বাড়ায় কারিগররা মজুরিও কিছুটা বেশি নেন বলে জানান পিন্টু। যার প্রভাব গহনার দামেও পড়ে বলে জানান এ স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুস সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আসন্ন বিয়ের মৌসুমে স্বর্ণের দাম ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব ফেলবে মানুষের বাজেটে। আগে মানুষ ৫-১০ ভরি গহনা বানালেও এখন খুঁজছে দুই থেকে আড়াই ভরির গহনা। কারণ বর্তমানে বাড়তে বাড়তে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে স্বর্ণের দাম।’

তিনি বলেন, ‘আগে বিত্তবানরা প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ কিনতেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। তবে তারাও এখন স্বর্ণ কেনার পরিমাণ  আগের তুলনায় অনেক কমিয়ে দিয়েছেন।’

স্বর্ণের দামের এই ঊর্ধ্বমুখীতায় দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্র্যান্ডের বড় বড় দোকানগুলোর বিক্রিও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কমে গেছে। আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থা তো আরও করুণ। ঊর্ধ্বমুখী এই দাম পুরো স্বর্ণ ব্যবসার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

স্বর্ণের দামের এই অস্থিরতার কারণ জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মূলত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ডলারের দাম ও ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার কমানোর প্রভাবে বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী, যার প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও।

বর্তমানে বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোই ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণ মজুত করছে। এছাড়া বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফার আশায় অধিক পরিমাণে স্বর্ণ কিনছেন। সব মিলিয়ে বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়ছে স্বর্ণের দাম বাড়ছে বলে জানান মাসুদ।

গত দুই বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৬১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বা ৫০ হাজার ৭০৩ টাকা। ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সমন্বয়কৃত দাম অনুযায়ী সেসময় ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে ৮২ হাজার ৩৪৮ টাকায়। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫১ টাকায়। আগামীতে স্বর্ণের দাম কমার নেই কোনো আভাস। আর সব মিলিয়ে বাড়তি দাম ভাঁজ ফেলবে ক্রেতাদের কপালে- এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে