এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার ২০টি নদ-নদীতে ইলিশ আহরণ বেড়েছে। মৎস্য অফিস ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বললেও বিক্রেতারা বলছেন বাজারে সরবরাহ কম। এ কারণে চড়া দামেই ইলিশ কিনছে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) দুপুর পর্যন্ত খুলনার আতাই নদী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অসংখ্য নৌকা নদীতে। প্রতি নৌকায় জাল নিয়ে একজন জেলে ইলিশ আহরণ করছেন। আতাই নদীর দিঘলিয়ার মল্লিকপুর এলাকা থেকে জাল পেতে ভাটার টানে নৌকায় ভেসে চরেরহাটে নদীর তিন মোহনায় ভৈরব নদে গিয়ে জাল তুলছে। একইভাবে ভাটার সময়ে তারা মাছ ধরছে।
মল্লিকপুর ঘাটে কথা হয় জেলে রতন শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, আতাই নদীতে আমরা ইলিশ ধরি। নদীর জোয়ার উঠে যখন ভাটা নামে তখন আমরা ইলিশ ধরার জন্য নামি। এই নদীতে অন্তত এক-দেড়শ জেলে রয়েছে। এই নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি। বরিশালের নদীর ইলিশের পাশাপাশি আমাদের এই নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি। এই মাছগুলো মুকামপুর বাজার, মল্লিকপুর বাজারে বিক্রি করি। সেখানে ফড়িয়ারা এসে মাছ কিনে নিয়ে যায়।
জেলে মনসুর মোল্লা বলেন, আতাই নদীতে প্রতিদিন একটা-দুটো ইলিশ পেয়ে জীবন-যাপন করছি। আষাঢ়- শ্রাবণ থেকে আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত নদীতে ইলিশ আহরণ করি। ভাটার সময়ে ইলিশ ধরি, আবার জোয়ারে উঠে যাই। জোয়ারের সময়ে বড় জাল নিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। আবার ভাটার সময় উঠে যায় তারা। এভাবেই দিন-রাত ইলিশ ধরা হয়।
নূর ইসলাম শেখ বলেন, মিল-কলকারখানা বন্ধ। বেকার অনেকেই। এখানে রুপালি ইলিশ ধরি। এই ইলিশ ধরার ওপরে ভরসা করে আছে সবাই। খোট জাল দিয়ে ইলিশ ধরি। নদীর ৪০-৫০ হাত পানির তলে জাল ছেড়ে দেই। পরে টানতে থাকি, টানতে টানতে ইলিশ বাঁধলে বুঝি, তখন উঠিয়ে নিই। এভাবেই ধরি। আগের চেয়ে কম ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সামনে অভিযান ২২ দিন, এ সময় ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। জেলে কার্ডও পাইনি। কীভাবে চলব জানি না।
জেলে এনামুল শেখ বলেন, কোনো কোনো দিন ৪-৫টা, আবার কোনো দিন একটা-দুইটা ইলিশ পাই। এখন পাওয়া যাচ্ছে। একটু আগে একটি ইলিশ পেয়েছি। এই ইলিশ বিক্রি করি, আবার সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাই। ১২ অক্টোবর শেষ মাছ ধরতে পারব। তারপর ২২ দিন বন্ধ থাকে।
আতাই নদীর কিনারাই দাঁড়িয়ে থাকা মশিউর রহমান জনি বলেন, নদীতে ইলিশ মাছ ধরে শুনে এসেছি। অনেকেই ইলিশ ধরছে। এখানে তাজা ইলিশ পাওয়া যায়। তবে দাম একটু বেশি। ছোট সাইজের ইলিশ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি বলছে। তাজা ইলিশ কিনবো বলে ঘুরে দেখছি।
শুধু আতাই নদীই নয়, ইলিশ আহরণ হয় খুলনার ২০টি নদ-নদীতে। জেলা মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, খুলনার পশুর, শিবসা, ভদ্রা, ঢাকী, চুনকুড়ি, ঝপঝপিয়া, কাজীবাছা, শৈলমারী, গেংরাইল, হরি নদী, ভদ্রা নদী, দেলুটি, হাবরখানা, ভৈরব, রূপসা, আতাই, মজুদখালী, কপোতাক্ষ, কয়রা ও শেখের বাড়িয়া নদীতে জেলেরা ইলিশ আহরণ করেন। এসব নদীতে ৩ হাজার ৪৫০ জন জেলে শুধু ইলিশ আহরণ করে থাকেন।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিগত তিন অর্থবছরে খুলনার নদ-নদীতে বেড়েছে ইলিশ আহরণ। এখানকার ২০টি নদী এবং আড়ত ও অবতরণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানিয়েছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২ হাজার ২৫৫ মেট্রিক টন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। তিন অর্থবছরে প্রায় ২৫ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ বেড়েছে। এছাড়া চলতি অর্থ বছরের তিন মাসে খুলনার নদ-নদী থেকে ৭৮৬ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করেছেন জেলেরা।
মৎস্য অফিসের পরিসংখ্যানে ইলিশ আহরণ বাড়ার তথ্য মিললেও ভিন্ন কথা বলছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, আড়ত ও বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। ফলে বেড়েছে ইলিশের দাম।
নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি সাইজের ইলিশের কেজি ১৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা, এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ২২০০ টাকা থেকে ২৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। আর ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৫৫০ টাকা, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ ১৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া তিন পিস মিলিয়ে এক কেজি ইলিশের দাম ৯০০ টাকা, ছোট সাইজের (জাটকা) ইলিশ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর ৫নং ঘাটের মৎস্য আড়তের মো. বেল্লাল বলেন, এ বছর মাছের সরবরাহ কম। এ জন্য ইলিশের দাম বেশি। আগে জাটকা ইলিশ মৌসুমের এই সময়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ছিল, সেই মাছ এই বছর হয়েছে ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি। এই অবস্থা বাজারের।
ইলিশ বিক্রেতা মো, আলমগীর হোসেন বলেন, আগে যে পরিমাণ মাছ আসতো, এখন সেই পরিমাণ মাছ আসে না। আগে এখানকার ১০টি ঘরে মাছ আসতো, এখন ৩-৪টি ঘরে মাছ আসে। ইলিশের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এই কারণে দাম বেশি। আমি এলসি (৮০০-৯০০ গ্রাম) সাইজের ইলিশ কিনেছি ১৭০০ টাকা কেজিতে। খুচরা বাজারে এই মাছ বিক্রি করব ১৮০০ টাকা কেজিতে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, খুলনার ২০টি নদ-নদী থেকে ইলিশ আহরণ করে থাকেন জেলেরা। জেলায় ৪৫ হাজার মৎস্যজীবী রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৫০জন মূলত ইলিশ আহরণ করে থাকেন। বিগত বছরগুলোতে খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীতে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
খুলনার নদ-নদীতে ইলিশের মাইগ্রেশনে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুলনার নদ-নদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে, এতে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এছাড়া কিছু কিছু নদীর পাড়ে কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের দুষণ আর সেনিটেশনের কারণে ইলিশের মাইগ্রেশন মূলত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
ইলিশের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জয়দেব পাল বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীতে যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, এটি সমন্বিতভাবে যদি বাজার মনিটরিং করা হয় তাহলে ইলিশের দামটি অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ইলিশের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব।