শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৩৭:৪৪

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়

রোকনুজ্জামান পিয়াস : প্রতিশ্রুতি আর সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ। এক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল দেশটি। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

দীর্ঘ ৪ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয় জি টু জি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক কর্মী যাবে দেশটিতে। ওই বছরের নভেম্বরে চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। সারা দেশ থেকে ১৪ লাখ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুর ডাটাবেজ তৈরি করা হয়।

বহু দেনদরবার করে সেসময় দুই-তিন দফায় ৭ হাজারের মতো কর্মী গেলেও কার্যত বন্ধই ছিল দেশটিতে  কর্মী প্রেরণ। এ নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিসহ বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার মুখে পড়ে সরকারি এ পদ্ধতি। এরপরও বারবার বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠানোর প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছে সরকার। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।

গতকালও বড় পরিসরে কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যে দেশটির সঙ্গে নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এবার সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কর্মী পাঠানো যাবে বলে জানানো হয়। বলা হচ্ছে, নতুন পদ্ধতির কথা। ‘জি টু জি প্লাস।’ তবে এ পদ্ধতিও কতটুকু সফলতা আনবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ১৫ লাখ কর্মী প্রেরণের যে কথা বলা হচ্ছে তা শুধুই রাজনৈতিক। উভয় দেশের সরকারই মাঝে মাঝে এসব প্রচার করে ফায়দা নিয়ে থাকেন। এমন কি এ সংখ্যার কথা উল্লেখ করে দেশের সাধারণ মানুষকেও ধোঁকা দেয়া হচ্ছে।

পাশাপাশি সারা দেশের দালালদেরও সক্রিয় হওয়ার সুয়োগ করে দেয়া হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। আগের রেজিস্ট্রেশনকৃত ১৪ লাখের বাইরেও নতুন করে কর্মী নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যা সাধারণ  মানুষকে বারবার ধোঁকা দেয়ার শামিল বলেও তারা মনে করেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন এ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও। এমনকি সরকারের পাশাপাশি যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী যাবে বলে বলা হচ্ছে তারাও সন্দিহান।

এসব নিত্যনতুন পদ্ধতির আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না। তাদের মতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৬৪টি দেশে যেভাবে কর্মী প্রেরণ করা হয় বা অন্যান্য দেশ যেভাবে কর্মী পাঠায় সেই পদ্ধতিই সবচেয়ে উপযুক্ত। নিত্যনতুন এসব পদ্ধতির আড়ালে একটি সিন্ডিকেট চক্র গড়ে ওঠতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা। আর এ আশঙ্কা সত্য হলে জি টু জি পদ্ধতির মতো নতুন এ পদ্ধতিও ব্যর্থ হতে পারে।

২০১২ সালের নভেম্বর মাসে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে সরকারিভাবে (জি টু জি) কর্মী প্রেরণের চুক্তি অনুযায়ী বনায়ন খাতে দেশটি বিপুলসংখ্যক কর্মী নেয়ার কথা ছিল। যদিও শুরু থেকেই বেসরকারিভাবে শ্রমিক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা এর বিরোধিতা করে আসছিল।

রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের বিরোধিতার মুখেই ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু করে সরকার। মালয়েশিয়া সরকারের আশ্বাসে কর্মী প্রেরণের আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিএমইটির মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশটিতে যেতে ইচ্ছুক প্রায় ১৪ লাখ মানুষের ডাটাবেজ তৈরি করে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত কর্মী গেছে সর্বসাকুল্যে ৭ হাজারের মতো। তারপরও  সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বারবার প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছে।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের নেতৃত্বে জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তখনকার মহাপরিচালক বেগম শামসুন নাহার ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুল ইসলাম ও সরকারের পররাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়া সফর করে।

ওই সফর থেকে ফিরে এসেও তারা একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। ৫ দিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান শেষে প্রতিনিধি দলটি দেশে ফিরে জানায় ১২০০০ কর্মী প্রেরণের কথা। সেই মতো গত বছরের জানুয়ারিতে ওই সংখ্যক কর্মী যাওয়ার কথা ছিল। ওই সফর থেকে ফিরে এসে বলা হয়, আগে জি টু জি পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু বনায়ন খাতে কর্মী নিয়োগ করা হতো।

কিন্তু এবার আরও কিছু খাতে  কর্মী প্রেরণ করা হবে। তারা কৃষিখাতের পাশাপাশি ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কলকারখানায় ১২ হাজার পুরুষ শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ ছাড়া গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। সে হিসেবে ওই সফরে সারওয়াক প্রদেশও পরিদর্শন করে প্রতিনিধি দলটি। কিন্তু সেটাও প্রতিশ্রুতিতেই বন্দি হয়ে পড়ে।

বরাবরের মতো তাই এবারও এই চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দিহান তারা। তাদের দাবি, ইতিপূর্বেও এ ধরনের অনেক সমঝোতা হয়েছে, প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি।

এ চুক্তির ব্যাপারে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর যে কথা বলা হচ্ছে তা রাজনৈতিক। ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার কথা চুক্তিতে বলা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দিহান।

এমনকি কি কি চুক্তি হয়েছে সে বিষয়টিও পরিষ্কার না। জি টু জি প্লাসের কথা বলা হলেও কোন প্রক্রিয়ায় যাবে, কিভাবে ম্যাকানিজম করবে তাও স্পষ্ট নয়। চুক্তির কপি যদি সাংবাদিকদের দিয়ে দেয়া হতো তাহলে জানা যেতো এর ভেতরে কি আছে। তিনি বলেন, সংখ্যাটা উল্লেখ করার দরকার ছিল না। সংখ্যাটা উল্লেখ করে আগের মতোই সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে।

উভয় দেশের সরকারই এ থেকে ফায়দা নিচ্ছে। কর্মী পাঠাতে ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচের যে কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে বায়রা থেকেও নানা কথা শোনা যাচ্ছে। তারা বলছে, পারবে না। তাদের সঙ্গে বসেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি।  তিনি বলেন, এর আগে ১৪ লাখ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু রেজিস্ট্রেশন করেছিল। তাহলে এখন আবার নতুন করে রেজিস্ট্রেশনের দরকার কি?

সাইফুল হক, বলেন আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়া হলে জি টু জি’র মতো এটিও ব্যর্থ হবে। বায়রা নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. নুরুল আমিন বলেন, চুক্তি হলেও আমরা এখনও কোনো খসড়া হাতে পাইনি। হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই একটি মহল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জি টু জি প্লাস শব্দটার দরকার কি?  রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করবে, সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। চুক্তিতে ১৫ লাখ কর্মী প্রেরণের বিষয়টি উল্লেখ আছে কিনা তাও তিনি নিশ্চিত না। বায়রা সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, এই ১৫ লাখ লোক যদি যেতে পারে তবে দেশের বেকারত্ব কমবে। দেশের রেমিট্যান্সও বাড়বে।

জি টু জি’র ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলেও তিনি বলেন, নতুন এ পদ্ধতিতে রিক্রুটিং এজেন্সি সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে আগের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ থাকবে। অভিবাসন ব্যয় কমানোর পক্ষে মত দিলেও তিনি বলেন ৪০-৪৫ হাজার টাকার মধ্যে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। মন্ত্রণালয়ের লোক দিয়ে একটি মনিটরিং শেল তৈরির কথাও বলেন তিনি।  -এম.জমিন

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে