মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০:০৮:৫৪

বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে রাজি আওয়ামী লীগ : হাছান মাহমুদ

বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে রাজি আওয়ামী লীগ : হাছান মাহমুদ

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল এস’-এর মতামত বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘অভিমত’-এ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রথমবার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।

গত ৩ নভেম্বর ‘আওয়ামী লীগ: তটস্থ, হতাশ, কোনঠাসা?’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্যের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

অনুষ্ঠান সঞ্চালক বুলবুল হাসানের এক প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ইতোপূর্বেও ঘটেছে। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ইতোপূর্বে বিপর্যয় কাটিয়ে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরপর চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়েছিল। আমরা আরও বড় বিপর্যয়ে পড়েছিলাম, সেগুলো আমরা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবারে। জাতীয় ৪ নেতাকেও হত্যা করা হয়েছিল। এবারও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। আমরা যে বুঝতে পারিনি তা নয়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই কিন্তু ৫ আগস্টের পরিবর্তিত ঘটনা হয়েছে।

ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি—উল্লেখ করে হাছান মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আমি বিএনপির দায়িত্বশীলদের বক্তব্য দেখেছি। তারাও এটার বিরোধিতা করেছে। কোনো রাজনৈতিক দলকে কাগজে কলমে নিষিদ্ধ করলেও কিন্তু সেটি নিষিদ্ধ হয়ে যায় না। ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর যখন প্রথম নির্বাচন হয়, সেভেন্টি নাইনে যখন পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়— আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকের মতে কমে গিয়েছিল তখন। সেই সময় আওয়ামী লীগ ৩৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। এখন একেবারে কমপক্ষে বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের কথা যারা ভাবেন সেটি অলীক একটি কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এই বাংলাদেশের সৃষ্টি, যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ললাটে বহুবিদ অর্জন—সেই রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের কথা যারা ভাবেন তারা কীভাবে ভাবেন, কেন ভাবেন তা বোধগম্য নয়।

হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে। কারও কারও মতে এই সমস্ত মামলার আসামি ৬ মিলিয়ন। তৃণমূল পর্যায়ের ওয়ার্ড লেভেলের কর্মীর বাড়িতেও তল্লাশী চালানো হচ্ছে পুলিশ দিয়ে। তারা ঘর বাড়িতে থাকতে পারছে না। আমাদের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড হত্যাকাণ্ড যে বলছে, হত্যাকাণ্ড তো এখনো চলছে। এগুলোকে হত্যাকাণ্ড মনে করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে পুলিশকে যখন আক্রমণ করা হয়, পুলিশের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? আত্মরক্ষার্থে পুলিশ তখন গুলি ছোঁড়েনি তা নয়, অবশ্যই ছুঁড়েছে। সেজন্য পুলিশের দায় আমরা কখনো অস্বীকার করিনি বা সরকার পক্ষের দায় আমরা কখনো অস্বীকার করিনি। এখনো অস্বীকার করছি না। অবশ্যই দায়িত্বে থাকলে দায় নিতে হবে। সেই দায় থেকেই শেখ হাসিনা সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ৫ আগস্টের আগে আমাদের বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সেটির ডাটা আমরা তৈরি করছি, প্রকাশ করা হবে।

সাবেক এই মন্ত্রী আরও বলেন, মৃত্যুর যে সংখ্যা-তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেটি আসলে কত? সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। আসলে কতজন হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছে সেই নামটা প্রকাশ করুক। আমি মনে করি, প্রথম থেকেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের যে দাবি ছিল, সেই বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের হাতে ছেড়ে না দিয়ে যদি বিষয়টি অন্যভাবে হ্যান্ডেল করা যেত তাহলে ভালো হতো। এটিকে এতদূর যেতে দেওয়াটাই ভুল ছিল আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বড় ভুল বা ব্যর্থতা কী ছিল—এ প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, সরকারে থাকলে ভুল হবেই। পৃথিবীর কোনো সরকার শতভাগ নির্ভুল কাজ করতে পারবে না। আমাদেরও অনেক ভুল ছিল। শুধু একটি দুটি ভুল নয়, দায়িত্বে থাকলে ভুল হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি—এটি আমার দলের অভিমত নয়, ব্যক্তি ড. হাছান মাহমুদের অভিমত হচ্ছে…আমি মনে করি বিএনপি অবশ্যই সব সময় নির্বাচন বর্জন করেছে, নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু যেহেতু আমরা দায়িত্ব ছিলাম, বিএনপিকে নির্বাচনে অ্যাকোমোডেট করতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা ছিল। ১৪ সালে, ২৪ সালে নির্বাচনে আনতে না পারা আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছিল। যদিও তারা আমাদেরকে ব্যর্থ করার চেষ্টাই করেছে, তবুও এটা আমাদের ব্যর্থতা।

ছাত্রশিবিরের অনেকেই ছাত্রলীগ করেছে—এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এমন ঘটেনি। এটা এখন আশ্চর্যজনক মনে হচ্ছে যে এটা কীভাবে সম্ভব হলো এবং আমাদের ছাত্রনেতারা কীভাবে এটা নোটিশ করতে পারলো না। এটি আমাকেও বিস্মিত করেছে।

তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যেভাবে মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, আমি রিজয়েন্ডার দিয়েছি প্রত্যেকটা খবরের। একটি ছাড়া কোনোটাই ছাপানো হয়নি। বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এগুলো কি ছিল আওয়ামী লীগের সময়? আমাদের সময় গণমাধ্যম যে স্বাধীনতা ভোগ করেছে সেটি অনেক উন্নয়নশীল দেশে পারেনি।

দলের পরবর্তী নেতৃত্ব প্রসঙ্গে হাছান মাহমুদ বলেন, দলে সব সময় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনাই প্রাণ এবং শেখ হাসিনা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণ ভোমরা। তাকে ছাড়া আওয়ামী লীগ কল্পনা করা যায় না। দলে গণতন্ত্র আছে তাই কোনো লাইনআপ তৈরি করা নেই। সময় এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। ১/১১ সরকারের সময় বিএনপির সঙ্গে একজোট হয়েই আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করেছিলাম এবং গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সাহেব কিংবা বিএনপির মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যে বক্তব্যগুলো দিচ্ছেন সেগুলোর অনেকগুলোর সঙ্গে আমি একমত। গতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য যদি প্রয়োজন হয়, অবশ্যই বিএনপির সঙ্গে একযোগে কাজ করতে আমরা তৈরি আছি, এক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত নেই। তারা রাষ্ট্রপতি ইস্যু থেকে শুরু করে দেশে যেন সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে তাদের যে স্ট্যান্ড সে ব্যাপারে আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করি। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হওয়ার পর বিএনপির যে বক্তব্য সেই বক্তব্যের সঙ্গেও আমি একমত। একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়ে, রাজনৈতিক দলের অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হলো এ নিয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য পাচ্ছি না। অত্যন্ত হতাশ হচ্ছি, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি।

মনে রাখতে হবে, কোনো সরকারই কিন্তু শেষ সরকার নয়—এ কথা উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরাও কিন্তু শেষ সরকার ছিলাম না। অনেকে মনে করেনি, সেটা সঠিক। কিন্তু আমি সব সময় মনে রেখেছি। ফলে এই সরকারই শেষ সরকার নয় সেটা মনে রাখতে হবে। তারা যে আগের সরকারের মন্ত্রীদের হাতকড়া পরালেন, ডিম ছুঁড়লেন—ভবিষ্যতের যে ভয়ংকর একটা উদাহরণ তৈরি করে গেলেন, ভবিষ্যতে কী ঘটে সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং আমি বিএনপির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে একমত এবং বিএনপি যে গণতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের কথা বলছে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে সেটির সাথে আমরা একমত। প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গে আমরা একযোগে গণতন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা কাজ করবো।

তিনি বলেন, আমরা চাই দেশ ভালো থাকুক। আজকে জাতীয় জীবনে হতাশা নেমে এসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশে একটি আপার হাউজ দরকার, এতে অনেক কোয়ালিটিফুল মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন। এ ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও বক্তব্য রেখেছেন, তিনিও আপার হাইজের পক্ষে বলেছেন। আমি খোলাসা করে বলছি এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত এটি আমার দলের অভিমত নয়।

তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের অনেকগুলো সংস্কার দরকার। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যেটি বলেছেন আমি তার সঙ্গে শতভাগ একমত। আমি মনে করি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই রাষ্ট্র সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আমরা সচেতনভাবেই অপেক্ষা করছি। এখন যদি আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নামতাম তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে অনেকে বলতো আমাদের কারণে তারা রাষ্ট্র সংস্কার করতে পারছে না। তাই সচেতনভাবেই আমরা একটু নিশ্চুপ আছি, যাতে আমাদের ওপর দোষ না আসে। আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যে দলের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী আছে, কোটি কোটি সমর্থক আছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ ফুরিয়ে যায়নি, আওয়ামী লীগ কখনো ফুরিয়ে যাবে না।

আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা করছে কিনা জানতে চাইলে হাছান মাহমুদ বলেন, এ ধরনের চিন্তা ভাবনার কথা শুনিনি। এ ধরনের কোনো আলোচনা কারও সাথে হয়নি।

দেশে ফিরে আসার সুযোগ হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনোই নয়। আমি মনে করি আমার দলও প্রতিহিংসামূলক আচরণ করার পক্ষপাতী নয়। কেউ খারাপ উদাহরণ তৈরি করলে সেই খারাপ উদাহরণকে অনুসরণ করতে নেই।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের, অহংকারের। আমাদের সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রফেশনাল। সেনাবাহিনীকে যারা বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে আমি সেটার বিরুদ্ধে।

দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমার দলের নেতাকর্মীদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। পঁচাত্তরের পরে কঠিন সময় গেছে এবং দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দল পরপর ৪বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেছে। নেতাকর্মীদের ওপর আজকে যে নির্যাতন, নিপীড়ন হচ্ছে…তাদেরকে বলবো এই আঁধার কেটে যাবে এবং সহসা দেশে একটি সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে।

জননেত্রী শেখ হাসিনা সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন, সবার সাথে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। তার মনোবল শতভাগ চাঙ্গা আছে। নেতাকর্মীদের বলব, যখন এই আঁধার কেটে যাবে তখন আমরা সবার প্রতি সহনশীল আচরণ করবো। অবশ্যই রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা সেই ভুলগুলো স্বীকার করছি। ভুল থেকেই মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে