এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক: সদ্য এএইচসি পাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাবনা জেলার রোহান। প্রকৌশল বিভাগে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। যথাযথ নিয়ম মেনে কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর প্রোগ্রামে আবেদন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি আবেদনটি পর্যালোচনা করে তাকে ভর্তির যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে মেইলে অফার লেটার পাঠান।
এই অফার লেটারসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র একাধিকবার ভারতীয় দূতাবাসে মেইল করার পরও কোনো ফিডব্যাক পাননি রোহান। পাশাপাশি ভিসা সেন্টারগুলোর স্লট না পেয়ে ভিসার জন্য আবেদনও করতে পারেননি এই শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত ভিসা করতে না পেরে নিজের উচ্চশিক্ষা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন তিনি।
এই শিক্ষার্থী জানান, ভিসা জটিলতায় কলকাতা যেতে না পারায় এখনো ভর্তি কনফার্ম করতে পারিনি। একাধিকবার দূতাবাসে গিয়ে কথা বলেছি, তাদের কথা অনুযায়ী কাগজপত্র মেইলে পাঠিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে দু’বার ভর্তির তারিখ বাড়িয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী ২২ নভেম্বর ভর্তির শেষ দিন, জানি না তার আগে ভিসা পাবো কি না।
এদিকে ভারত থেকে অফার লেটার পাওয়ায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হননি রোহান। ফলে তার উচ্চশিক্ষা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। শুধু রোহান নয়, এমন অভিযোগ প্রায় ডজনখানেক শিক্ষার্থীর। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেয়েও নির্দিষ্ট সময়ে ভিসা না পাওয়ায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বর্ণা নামের ঝিনাইদহ জেলার এক শিক্ষার্থী গত সেপ্টেম্বর মাসে অফার লেটার পেয়েছেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন পর্যন্ত ভিসা জমা দেয়ার জন্য কোনো স্লট পাননি তিনি। ফলে ভিসা জটিলতায় আটকে গেছে তার উচ্চশিক্ষার আশা।
প্রায় সাড়ে তিনমাস চেষ্টা করে বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) ভিসা পেয়েছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার্থী মো. সাবদার। তিনি বলেন, গত ৬ আগস্ট আমি ভিসার ফরম জমা দেয়ার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। কিন্তু ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সব ভিসা সেন্টার বন্ধ হয়ে গেল। এরপরে কার্যক্রম শুরু হলেও টাকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা তৈরি হয়। আর টাকা জমা না দিলে আমি কোনো ভিসা সেন্টারে ফরম জমা দিতে পারবো না। দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে স্লট খোলা আছে পেমেন্ট করা যাবে, কিন্তু বাস্তবে মাত্র ৩/৪ মিনিটের জন্য স্লট খোলা হচ্ছে। এই সময়ে সার্ভারে এত পরিমাণ হিট হয় যে, সবার পক্ষে টাকা জমা দেয়া কষ্টকর। সবকিছু মিলিয়ে অনেক কষ্ট করে প্রায় সাড়ে তিন মাস ভিসা পেয়েছি। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতে গিয়ে ভর্তি হতে পারবো।
শিক্ষার্থীদের এমন ভোগান্তির বিষয়ে কথা হয় ভারতীয় দূতাবাসের শিক্ষা উইংয়ের প্রধান বলয় চক্রবর্তীর সঙ্গে। এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ডেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদেরকে স্লট দেয়ার ব্যবস্থা করছি। পরে কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই তারা ভিসার কাগজপত্র জমা দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টা সহজে করার, এখন পর্যন্ত আমরা আপ টু ডেট আছি। মূলত ৫ তারিখের পরিস্থিতির কারণে কিছু গ্যাপ হয়েছিল, আমরা সেটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং যে গ্যাপ হয়েছে তা অতিরিক্ত ক্লাসের মাধ্যমে ব্যাল্যান্স করতে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে জরুরি ভিসা ছাড়া অন্যান্য ভিসা বন্ধ থাকায় অনেকে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ভুয়া কাগজপত্র জমা করছেন। এক্ষেত্রে আমরা যাচাই-বাছাই করে সাক্ষাৎকার নিয়ে অনেথটিক আবেদনগুলোর জন্য স্লট দিচ্ছি। বিষয়টা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এদিকে ভিসা জটিলতায় কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাওয়া বেশকিছু শিক্ষার্থীর ভর্তি প্রক্রিয়া থমকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় তরফে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ভিসা পাওয়া সহজ করতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। এছাড়া তাদের থেকে অফার লেটার পাওয়া শিক্ষার্থীদের লিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে দূতাবাস থেকে সহজেই আবেদনকারীর তথ্য যাচাই-বাছাই করা যায়।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির চেয়ারম্যান ড. কাজী মোহাম্মদ আলফ্রেড বলেন, প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে আমরা অফার লেটার দিয়েছি, এদের মধ্যে অধিকাংশই ভিসা না পাওয়ায় ভর্তি হতে পারেনি। মাত্র ৩/৪ জন ভর্তি হয়েছেন, তাদেরও অন্য ভিসা থাকায় কলকাতায় এসে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দুইবার করে ভর্তির সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন স্থানীয় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্লাস হয়ে গেছে, তিনমাস সময় দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ভর্তির সময় বাড়িয়ে ২২ নভেম্বর করা হয়েছে, এরপর আর সময় বাড়ানো সম্ভব হবে না। কারণ খুব দ্রুত সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়ে যাবে। সময় বাড়িয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নিলে তারা ব্যাল্যান্স করবে কীভাবে।
আলফ্রেড বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক এটা আমরা চাই। বিদেশি শিক্ষার্থী বেশি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়ে। কিন্তু এমন ভিসা জটিলতায় যদি তাদের আসা আটকে যায়, সেটা দুঃখজনক। আমরা বোর্ড বসিয়ে আবেদন যাচাই-বাছাই করে তাদেরকে অফার লেটার দিয়েছি, কিন্তু তারা ভর্তি হতে না পারলে সেটা কষ্টকর হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও বিষয়টা আশাহত হচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মীর রেজাউল করিম বলেন, হাইকমিশন অফিস থেকে অনেক জায়গায় যথাযথ সহযোগিতা করা হচ্ছে না, এটা আমরা জানি। এ বছর আমরা ঢাকা রাজশাহীসহ প্রতিটি দূতাবাসে আমাদের অফার লেটার পাওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকা পাঠিয়ে ভিসা দিতে অনুরোধ করেছি, যাতে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হয়। কিন্তু তারপরও এই জটিলতা থেকেই গেছে।
যদিও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর আবেদন পাননি বলে জানিয়েছেন ভারতীয় দূতাবাস। শিক্ষা উইংয়ের প্রধান জানিয়েছেন, এ মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থীর আবেদন আমরা পাইনি। শিক্ষার্থীদের উচিত সঠিক চ্যানেল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট মেইলে কাগজপত্র পাঠানো। আমরা সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের স্লট দিচ্ছি। এ সময় দালালের কারণে ভিসাপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে উল্লেখ করে তাদের খপ্পরে না পড়ে প্রোপার চ্যানেলে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে ভারতীয় দূতাবাস।
এদিকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় তৃতীয় দেশে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরাও ভোগান্তিতে পড়েছেন। তবে এই ভোগান্তি লাঘবে পরামর্শ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তৃতীয় দেশে যেতে ইচ্ছুকরা ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান থেকে ভিসা নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তৌফিক হাসান। এছাড়া ভারতের ভিসা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানিয়েছে জনসংযোগ বিভাগ।