রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৫:১০:০৮

ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ তৃণমূলে

ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ তৃণমূলে

মাহমুদ আজহার, শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও রফিকুল ইসলাম রনি : ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তৃণমূলের বড় অংশেই অসন্তোষ চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে চলছে ক্ষোভ। বিএনপি-রাজাকারপুত্রকে মনোনয়ন দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ নিয়ে সড়ক অবরোধসহ গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপিতেও রয়েছে নানা অভিযোগ। স্বাক্ষর জাল করে প্রার্থী ঘোষণা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবসহ নানা অভিযোগ আসছে। এর মধ্যেই গতকাল পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করে বিএনপি। প্রার্থী বাছাইয়ে জাতীয় পার্টির এমপিরা কেন সহযোগিতা করছেন না— এমন অভিযোগ করেছেন দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।

তৃণমূল আওয়ামী লীগে ক্ষোভ : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের মহিষকুড় এলাকায় দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার সমর্থকদের কুপিয়ে জখম করেছে আওয়ামী লীগের অন্য গ্রুপ। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। দলীয় মনোনয়নের চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নোয়াখালীর হাতিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে চরঈশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আজাদ গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় কমপক্ষে আরও নয়জন আহত হন।

এমন হামলা শুধু সাতক্ষীরা ও নোয়াখালীতেই নয়, আরও বেশ কিছু এলাকায় ঘটেছে। আবার দলের জন্য ত্যাগী ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় বিক্ষোভ-মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সুযোগে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া বিএনপি নেতা, খুনের আসামি, স্বাধীনতাবিরোধীর সন্তান এবং মাদক ব্যবসায়ীরা।

প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে পক্ষপাতিত্বের কারণে ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের বিভিন্ন এলাকার শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। ইতিমধ্যেই কোনো কোনো স্থানে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেছেন তারা। যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নে গতকাল সকালে মহিষকুড় মুক্তিযোদ্ধা অফিসে বসে সমর্থকদের সঙ্গে গল্প করছিলেন বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল। এ সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর মোহাম্মদ ও তার সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালায়। আবু হেনা শাকিল ও তার ছেলেসহ ১০ জনকে কুপিয়ে জখম করে তারা।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের চিঠি নিয়ে ঢাকা থেকে নোয়াখালী জেলা সদর হয়ে হাতিয়ায় ফিরছিলেন চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। বিকালে হরণী ইউনিয়নের বয়ারচর হাতিয়া বাজারে পৌঁছলে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়।

খবর পেয়ে বয়ারচর ফাঁড়ির পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে নদীর ঘাটে পৌঁছে দেয়। পরে তারা স্পিডবোটে হাতিয়ায় আসার পথে নদীতে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে চরঈশ্বর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আজাদ গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।

এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ওয়ালিউল্লা জানান, যারা দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তারাই ক্ষিপ্ত হয়ে দলীয় প্রার্থীদের ওপর হামলা করেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমির অভিযোগ করেন, সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর লোকজন তার পোষা ডাকাত দলকে দিয়ে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ভাংনামারী ইউনিয়নে ‘নৌকা’ প্রতীকে উপজেলা বিএনপির সদস্যকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নেন। ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। এরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঞ্চিত প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। এর প্রতিবাদে মণিরামপুরের ১৭টি ইউনিয়নের হাটবাজার, মোড়ে মোড়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

মনোনয়নবঞ্চিত হরিহরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মনিরুজ্জামান মুকুল অভিযোগ করেন, উপজেলা কমিটির নেতাদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির এক নেতা টাকা খেয়ে তাকে মনোনয়নবঞ্চিত করেছেন।

অনিয়মের অভিযোগ বিএনপিতেও : বরিশালের গৌরনদীর ২ নম্বর বার্থী ইউনিয়নে আমিনুল ইসলাম শাহীনকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেয় বিএনপি। তৃণমূলের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই গতকাল সকালে গুলশান কার্যালয় থেকে শাহীনের হাতে দলীয় মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়।

তবে দুপুরে হঠাৎ করেই তার মনোনয়নপত্র স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার এক ফোনকলই কাল হয় শাহীনের। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে গৌরনদীতে। সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়েও ওই এলাকার নেতা-কর্মীরা অবস্থান করেন।

প্রার্থী বদল হলে বিক্ষোভ সমাবেশ করার হুমকি দিয়েছেন নেতা-কর্মীরা। আরেক এলাকা থেকে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কেন্দ্র থেকে ইউপি প্রার্থী ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে অবশ্য কেন্দ্র থেকে খোঁজখবর নিয়ে তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থীকেই মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়। বেশ কিছু এলাকা থেকে একাধিক প্রার্থীর নামও আসছে।

কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা একপক্ষকে বুঝিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করছেন। কেউ কেউ মানছে। আবার অনেকেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বতন্ত্রভাবে লড়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। ইউপি প্রার্থী ঘোষণার পর অনেক এলাকায় নেতা-কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের দারস্থও হচ্ছেন কোনো কোনো প্রার্থী। ঢাকায় বসে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের।

বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় মনিটর সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, গতকাল রাত পর্যন্ত সাড়ে ৫০০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বিলি করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে ২০টি, রংপুর বিভাগে ৮টি, খুলনা বিভাগে ১৭৯টি, রাজশাহী বিভাগে ৩১টি, বরিশালে ১৪৩টি মনোনয়নপত্র বিলি করা হয়।

ঢাকা বিভাগের কারও নাম ঘোষণা করা হয়নি। আজকের মধ্যেই ৭৩৯টি ইউপির মনোনয়নপত্র ঘোষণা করবে দলটি। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার ঘটনায় মনোনয়ন বঞ্চিতরা উপজেলা কার্যালয় ভাঙচুর করেন।

মনোনয়ন বঞ্চিতদের অভিযোগ, উপজেলায় বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচনী বোর্ড প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা। কিন্তু উপজেলায় তারা প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে ঢাকায় বসেই শেরপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ফাহিম চৌধুরীর পরামর্শে টাকার বিনিময়ে ১২টি ইউনিয়নের তালিকা চূড়ান্ত করেছে।

এটা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর শহরের উত্তর বাজার এলাকায় বিএনপির কার্যালয়ে তালা ভেঙে ভিতরে থাকা চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। মনোনয়নবঞ্চিত উপজেলা বিএনপির সদস্য ও  নয়াবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান জানান, টাকার বিনিময়ে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটা কোনোভাবে মানা হবে না।

এমপিদের সহযোগিতা পাচ্ছে না জাপা : জাতীয় পার্টির তৃণমূলে বাড়ছে অসন্তোষ। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলের এমপিদের পাশে পাচ্ছেন না তারা। এমপিরা চলেন রওশন এরশাদের কথায়। আর রওশনপন্থি এমপিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যতদিন পর্যন্ত রওশন এরশাদকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা না করা হবে ততদিন পর্যন্ত তারা এরশাদের কোনো সভা-সমাবেশে যাবেন না।

এ অবস্থায় দলের তৃণমূলে বাড়ছে অসন্তোষ। জানা যায়, বগুড়ায় জাতীয় পার্টির রয়েছেন চারজন এমপি। কিন্তু বগুড়া থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ছয়জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মোট ৩৮৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

আজ জাতীয় পার্টির মনোনয়নপত্র সংগ্রহের শেষ দিন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা আশা করছেন, আজ সর্বোচ্চ ৫০ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারেন। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজ রহমান বলেন, কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের সব নেতা-কর্মী মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে আমরা আশানুরূপ ফল পাব।

জানা যায়, জাতীয় সংসদে স্বীকৃত প্রধান বিরোধী দল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে চলছে নীরব সাংগঠনিক বিপর্যয়। সরকারি দল, না বিরোধী দল— এরকম আত্মপরিচয় সংকটে থাকা দলটিকে সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক নিপীড়ন-নির্যাতন কিংবা ধরপাকড় সামলাতে না হলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেকে গোছাতে পারেনি।

তবে পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনার পর দলে একটি অংশ চাঙ্গা হলেও পার্টির অধিকাংশ এএমপি এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। জাপার প্রেসিডিয়ামের কয়েকজন সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, সরকারের ভিতরে এক পা এবং বাইরে এক পা রেখে রাজনীতি করছে জাপা।

দলটি সোনার বাটি না পাথর বাটি, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের মতবিরোধ প্রকাশ্যে। এ নিয়ে তৃণমূলে বাড়ছে অসন্তোষ। -বিডি প্রতিদিন
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে