রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৬:৩৯:৩১

‘বহির্বিশ্বে সম্মান থাকলেও দেশে অবহেলিত বাংলাভাষা’

‘বহির্বিশ্বে সম্মান থাকলেও দেশে অবহেলিত বাংলাভাষা’

উৎপল রায় : ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেছেন, সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার সম্মানজনক অবস্থান থাকলেও দেশে বাংলা ভাষার কোনো কদর নেই।

তিনি আরও বলেছেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এখন সময়ের দাবি। বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান রেখে এ দাবি সরকারকে পূরণ করতে হবে। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।

কামাল লোহানী বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেন সবার অনীহা। বিকৃত উচ্চারণ, ভুল বাক্য ও শব্দ বলা ও লেখার মাধ্যমে বাংলাকে চরম অবমাননা করা হচ্ছে। এটা হতাশা ও দুঃখজনক।

তিনি বলেন, আমাদের গর্বের বিষয় যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের ১৪৪টি দেশে বাংলা ভাষার প্রতি, এই ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। কোনো কোনো দেশে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবেও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। কত গর্বের বিষয় এটি। অথচ আমাদের দেশের অনেকের কাছে এ বিষয়টি গুরুত্বই পায় না।

তিনি বলেন, দুঃখ হয় ৬৪ বছর আগে ভাষা সৈনিকদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও জীবনদানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার কথা ছিল তা বিন্দু পরিমাণ আসেনি।

বাণিজ্যিকীকরণের কারণে বাংলা ভাষার অনাদর হচ্ছে- এমন মন্তব্য করে কামাল লোহানী বলেন, আমি ইংরেজি ভাষার বিরোধী নই। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন সেক্টরে ইংরেজি ভাষাকে বাংলার চাইতে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

ইংরেজি মাধ্যমের নামে কিছু স্কুল, কলেজে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করে বাংলা ভাষাকে রীতিমতো অবজ্ঞা করা হচ্ছে। এর মধ্যে যে বাণিজ্যিকীকরণের বিষয় রয়েছে- এ বিষয়টি কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। না শিক্ষার্থীদের অভিভাবক না সরকার। অভিভাবকরা হয়তো ভাবছে বিদেশে গমন, চাকরির ক্ষেত্রে বাংলার চাইতে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বেশি। কিন্তু বাংলাকে পাশ কাটিয়ে নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে শুধু স্বার্থবাদী চিন্তা চেতনা কতটুকু যৌক্তিক?

তিনি বলেন, খুব সূক্ষ্মভাবে বাণিজ্যিকীকরণ ও স্বার্থবাদী চিন্তার মাধ্যমে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এতে করে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একদিকে বাংলাকে যেমন অপমান করা হচ্ছে, আরেক দিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আবেগসহ দেশ প্রেম গড়ে উঠছে না।

কামাল লোহানী বলেন, আমাদের দেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের শ্রেণী চরিত্রের মধ্যে অভিজাতদের কাছাকাছি যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। যে কারণে কখনো কখনো তারা নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে দেয়। তাদের ধারণা অভিজাতদের কাছাকাছি যাবার উপায় তাদের মতো করে সবকিছু করা। এজন্য কেউ কেউ নিজের ভাষাকে বিকৃত ও অবহেলিত করে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে ধারণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

৬ দশকের বেশি সময় পরেও ভাষাসৈনিকদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না পাওয়া ও ভাষাসৈনিকদের সঠিক তালিকা না হওয়াকে দুঃখজনক উল্লেখ করে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণীজন বলেন, ভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সরকারের স্বীকৃতি হয়তো পেয়েছেন। কিন্তু  তাদের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজও মেলেনি।

তাদের কোনো তালিকাও হয়নি। ইতিমধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। তাদের অনেকেই  সরকারি স্বীকৃতিটুকুও পাননি। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শরফুদ্দিন আহমেদ। তিনি এখন জীবিত নেই। ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের ধারণা তার মনেই এসেছিল। অথচ তিনি কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাননি।

এ রকম অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচবেন। কিন্তু স্বীকৃতি মেলেনি। তিনি আরও বলেন, ভাষাসৈনিকদের একটি তালিকা করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু কয়েকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করেই দায় শেষ করা হয়েছে।

সরকার বলছে, দীর্ঘ সময় আগের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা করা খুবই কঠিন। কিন্তু আমি বলবো এটি কি খুবই কঠিন? অবশ্য এটিকে আমি সরকারের ব্যর্থতা বলবো না। সরকারের উদ্যোগের অভাব এটি।

কামাল লোহানী বলেন, আমরা যারা জীবিত আছি, তারা সহযোগিতা করতে পারি। ভাষা আন্দোলন তো এই দেশেই হয়েছে, এই দেশের মানুষই জীবন দিয়েছে, কারাবরণ করেছে, নির্যাতিত হয়েছে। তাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন।

ভাষাসৈনিক ছিলেন বলে অনেকে দাবিও করছেন। প্রতিটি জেলায় তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে এর একটি তালিকা আমরা পেয়ে যাবো। এরা সবাই জীবনের শেষ প্রান্তে। মৃত্যুর আগে অন্তত ভাষাসৈনিকদের তালিকায় নিজের নামটি দেখে যেতে পারতেন।
     
১৯৩৪ সালের ২৬শে জুন (১১ই আষাঢ় ১৩৪১ বঙ্গাব্দ) সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কামাল লোহানী। ’৫২-র শুরুতে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। থাকতেন পাবনা জেলায়। যোগ দেন ভাষা সংগ্রামে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে।

এ কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িত হন তিনি। ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’ বা প্রগতিবাদী ছাত্র জোটের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেয়ার অভিযোগে ’৫৩ ও ’৫৪ সালে একাধিকবার কারাবরণ করেন কামাল লোহানী।

বর্তমানে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সম্মান একুশে পদকসহ অসংখ্য স্মারক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। -এম.জমিন

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে