রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৬:৪৬:১৩

বিএনপিতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস

বিএনপিতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস

নিজস্ব প্রতিনিধি : প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন ক্ষমতায়। কঠোরতার জন্য সমালোচনা থাকলেও তার ব্যক্তিগত সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। তবে তার দলে যারা ভিড়েছিলেন তাদের অনেকেরই সে খ্যাতি ছিল না।

প্রেসিডেন্ট জিয়া একবার তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পবিত্র কোরআন হাতে দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করান। তারা অঙ্গীকার করেন- ঘুষ খাবেন না, দুর্নীতি করবেন না। এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর বিএনপির রাজনীতিতে অবিশ্বাসের ধারা প্রকট হয়।

সে সময়কার ঘটনার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় মহিউদ্দিন আহমদের সদ্য প্রকাশিত বই ‘বিএনপি: সময়-অসময়’-এ। যেখানে বলা হয়েছে, সাত্তারের মন্ত্রিসভা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এখানে নীতি বা আদর্শের কোনো বালাই ছিল না। একটা গ্রুপ ছিল সাত্তারের অনুগত।

অন্য গ্রুপটি নানা ছলছুঁতোয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মওদুদ আহমদ একসময় জিয়া সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরে জিয়ার নেকনজর থেকে তিনি ছিটকে (পৃষ্ঠা ১১ কলাম ৬) পড়েন এবং মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হন।

সাত্তারের সঙ্গে মওদুদের যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় এরশাদ মওদুদকে একদিন টেলিফোন করে বললেন যে, সাত্তারের সরকারে তার যোগ দেয়া ঠিক হবে না।

এরশাদ বলেছিলেন, ‘বিএনপিতে একমাত্র আপনারই ইমেজ আছে, আপনি এইরকম একটি সরকারের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন কেন? মওদুদের মনে হলো সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে মওদুদ বলেন, ‘এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনের আগে আমার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু এবার তাকে খুবই উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত মনে হলো।’

পরে বিএনপির রাজনীতিতে এ বিভক্তি প্রকট হওয়ার পটভূমিতে রাজনীতির মঞ্চে যোগ দেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ সময় মাঠের রাজনীতিতে ছিলেন বেগম জিয়া।

গণতান্ত্রিক জমানার প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। তবে এরপরের চলার পথ মসৃণ হয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও একশ’র বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। তবে বিএনপিতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা অব্যাহত থাকে।

২০০১ সালের নির্বাচনে দলটি ভূমিধস জয়লাভ করলেও সে খেলা থামেনি। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের ট্রাম্প কার্ড ঘিরে সেসময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে বিএনপির সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ পদত্যাগ করবেন। সে সময় পাল্টা কৌশলে দলটি তা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিল।

তবে সরকারের মেয়াদ শেষে একটি বড় অংশ ঠিকই বিএনপি ছেড়ে চলে যায়। এলডিপি নামে আত্মপ্রকাশ করে তারা। বিএনপির এর পরের কাহিনী পুরোটাই আত্ম প্রবঞ্চনার। আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান ইলেভেনে গর্তে পড়ে যায় বিএনপি।

মহিউদ্দিন আহমদ তার সদ্য প্রকাশিত বইয়ে লিখেছেন, ‘এই অভ্যুত্থানের প্রধান শিকার ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং। তার সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায় কয়েকজনের হাতে, যাদের তিনি তার প্রতি অনুগত মনে করতেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে, সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক প্রথা ভেঙে মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসানকে ডিঙ্গিয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত জুনিয়র মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছিলেন। জেনারেল জামিল বীর প্রতীক ছিলেন শেষ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা। বঙ্গভবনে অভ্যুত্থানের মূল কুশীলব ছিলেন রক্ষীবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে আসা চাকরিরত শেষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।

মইন ছিলেন খালেদা জিয়ার ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দরের কোর্সমেট এবং মাসুদ উদ্দিন হলেন সাঈদের ভায়রা ভাই। খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী থাকায় সাঈদের পক্ষে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ-বদলির ব্যাপারে নাক গলানো সহজ ছিল। মেজর জেনারেল ফাতমী একনাগাড়ে পাঁচ বছর এসএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন। তারা সবাই দৃশ্যপট থেকে খালেদা জিয়াকে সরানোর ব্যাপারে একজোট হয়েছিলেন।’

অন্যদিকে, রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এম সাইফুর রহমান-আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বেরুতে সক্ষম হলেও তার দুই ছেলে নির্বাসিত জীবনে চলে যান। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো বিদেশেই ইন্তেকাল করেন।

ওদিকে, রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভাগ্য আর বদলায়নি। দলে দৃশ্যত কোনো ভাঙন তৈরি না হলেও তলে তলে অনেকেই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বলে আলোচনা রয়েছে। বিগত আন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর বিএনপির এক শীর্ষ নেতা ক্ষমতাবান এক কর্মকর্তার বাসায় আশ্রয়ে ছিলেন বলেও আলোচনা রয়েছে।

এছাড়া, বিএনপি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশিরভাগ আলোচনা সহজেই পাস হয়ে যায়। এ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দিনের পর দিন নেতাদের সতর্ক করলেও এতে কোনো কাজ হয়নি। চলতি মাসেই স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে দলের নেতাদের আবারও হুঁশিয়ার করেন খালেদা জিয়া। তবে এসব হুঁশিয়ারিতে তেমন কোনো কাজ হবে বিএনপির খুব বেশি লোক তা বিশ্বাস করেন না।

সূত্রের দাবি, খালেদা জিয়া লন্ডন সফরের সময় তার ছেলে এবং দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে দল পুনর্গঠন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় পুনর্গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তও হয়েছিল।

কিন্তু অদৃশ্য কারণে সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। এমন বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। দৃশ্যত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল থেকে মুক্ত হতে পারছে না বিএনপি।   -এম.জমিন

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে