এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়ায় শারমীন বেগম ওরফে হরলুজা বেগম (৪৭) নামক নারীর মাথা বিচ্ছিন্নের পর শরীর আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আসামি ফারহান ভূঁইয়া রনি জবানবন্দি দিয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, জবানবন্দিতে রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন ঘাতক রনি। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের একমাত্র মূল হোতা ফারহান। সে আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার ছেলে। স্থানীয়রা তাকে মাদকাসক্ত ও ছিনতাইকারী হিসেবে চিনতেন।
ঘটনা যেভাবে সামনে আসে
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার জাহির মিয়া জানান, উপজেলার গাজীর বাজার এলাকার এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে গত রাতে রাজহাঁস চুরি হয়। মঙ্গলবার সকালে হাঁস খুঁজতে এসে শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার জায়গায় একটি টিনের পরিত্যক্ত ভাঙা ঘর থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে গন্ধ পান। এ সময় সেখানে থাকা ফারহান রনি জানান পাতা পোড়া দিচ্ছেন। এ কথায় বিশ্বাস না হলে হাঁসের মালিক দুই ভাই এনামুল, রোমান ও তাদের চাচাতো ভাই ওবায়দুল ওই ঘরে ঢোকেন। এ সময় ফারহান ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের মারার হুমকি দেন। এতে সন্দেহ বাড়লে গ্রামের লোকজন গিয়ে গর্তে পুড়তে থাকা লাশ দেখতে পান। পরে তারা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে।
পরে আটক ফারহান পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুড়িয়ে ফেলা নারীর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাটি মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয় একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। মাথা দেখে লাশের পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ।
হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশকে যা বলেছে ফারহান
গতকাল ঘটনাস্থল থেকে আটকের পর ফারহান পুলিশকে একেক সময় একেক তথ্য দিয়ে আসছিল। তবে পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, হত্যার শিকার হরলুজার স্বামী নুরুল ইসলাম তাদের বাড়িতে থেকে গত পাঁচ দশক ধরে তার বাপদাদার জমিতে চাষাবাদের কাজ করছেন। সেই সুবাদে ফারহানের দাদা তাদের জায়গায় নুরুল ইসলামকে একটি ঘর তুলে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে নুরুল ইসলাম তার স্ত্রী হরলুজা বেগমসহ তিন কন্যা নিয়েই তাদের জায়গায় থাকতেন।
তার দাবি, নুরুল ইসলাম কৃষি জমির পাশাপাশি গ্রামীণ জনপথে কলা বিক্রি করতেন। এর মধ্যে তার বিবাহিত তৃতীয় মেয়ে তাদের বাড়িতে থাকছেন। গৃহবধূ হরলুজা তার তৃতীয় মেয়েকে ফারহানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য খাবারের সঙ্গে প্রায়শই ঝাড়ফুঁক, তাবিজ ইত্যাদি করতেন। উদ্দেশ্য ছিল, যদি তার তৃতীয় মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে তাদের সম্পদের একটা বড় অংশ বৈবাহিক সূত্রে নুরুল ইসলামের মেয়ে জমির মালিক হবেন। এই বিষয়টি আঁচ করতে পারেন বলে দাবি করেন। এরপর হরলুজা বেগমের আচরণ নিয়ে প্রায়শই ক্ষুব্ধ হতো। এক পর্যায়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই নারীকে ভোর ৬টার দিকে বাবার অসুস্থতার কথা বলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আসে। পরে তাকে প্রথমে শ্বাসরুদ্ধ ও পরে জবাই দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। যেন কেউ তাকে চিনতে না পারেন।
পরে বাড়ির একটি পরিত্যক্ত টিনশেডের ঘরের ভেতরে গর্ত ভরে মস্তকবিহীন হরলুজার দেহটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আগুনে পোড়ার সময় ঘটনাস্থল বসাই ছিল ফারহান। এক পর্যায়ে পাশের বাড়ির লোকজন তাদের বাড়ি থেকে রাতে চুরি হওয়া হাঁস খুঁজতে গিয়ে পরিত্যক্ত ঘরের ভেতর তাকে দেখতে পান। এ সময় ঘরের ভেতরে ধোঁয়া বের হতে দেখেন তারা, পরে সেখানে এগিয়ে যান। পরিত্যক্ত ঘরের ভেতরে কী হচ্ছে জানতে চান, হাঁসের মালিক এনামুল-রুমান ও তাদের চাচাতো ভাই উবায়দুল। এ সময় ফারহান তাদেরকে ঘরের ভেতরে না আসার জন্য বারণ করে এবং হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে হারিয়ে যাওয়া হাঁসের মালিক তার আচরণ দেখে তাদের মধ্যে সন্দেহ জাগে, মনে করেন তাদের হারিয়ে যাওয়া হাঁস নিশ্চয়ই ফারহান চুরি করেছে। পাশাপাশি সেখানে সে একটা কিছু করছে। পরে হাঁসের মালিক দুই ভাই এলাকার লোকজনকে ডেকে এনে সন্দেহজনকভাবে তাকে ধরে ফেলেন। এক পর্যায়ে তারা ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখেন, ওই নারীর মস্তকবিহীন দেহ সে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় ওই নারীর দেহ দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটা কোন পুরুষ না মহিলা।
খবর পেয়ে আখাউড়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতের অঙ্গার দেহ উদ্ধার করে। পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে ফারহানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর বাড়ির পাশের একটি পুকুর থেকে নিহতের বিচ্ছিন্ন মাথাটি উদ্ধার করেন।
হত্যাকাণ্ডের শিকার গৃহবধূর বড় মেয়ে ও মামলার বাদীর বক্তব্য
এ ঘটনার পর নিহতের বড় মেয়ে রুমা আক্তার বাদী হয়ে ফারহান ভূঁইয়া রনিকে একমাত্র আসামি করে আখাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
রুমা বলেন, ঘাতক ফারহানসহ ওর ভাইবোনের জন্ম আমার মায়ের হাতের ওপর দিয়ে হয়েছে। তার প্রতিদান এভাবে দেওয়া হবে আমরা ভাবিনি। ওর বাবাকেও আমার মায়েই বিয়ে করিয়েছেন। এমন রোমহর্ষক ঘটনা ঘটাবে, আমরা চিন্তাও করিনি।
তিনি দাবি করেন, চুরি করা হাঁস জবাই করে রান্না করার জন্য রনি মা হরলুজা বেগমকে চাপ দিয়েছিলেন। সেটি না করার কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে রনি এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দাবি করছি।
পুলিশের ভাষ্য
ঘটনা সম্পর্কে আখাউড়া থানার ওসি ছমিউদ্দিন জানান, দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে হরলুজা বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে ফারহানদের জায়গায় বসবাস করছিলেন। সে মাদকাসক্ত। সে প্রায়শই চুরি-ছিনতায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে আখাউড়া থানায় মাদক মামলা, চুরি ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে নিহতের বড় মেয়ে রুমা আক্তার বাদী হয়ে ফারহানকে একমাত্র আসামি করে আখাউড়া থানায় হত্যা মামলা করেন। আমরা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তিনি জানান, যেহেতু এই মামলার একমাত্র আসামি ফারহান। তাই মামলাটির তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছি। আসামিও নিশ্চয়ই আইনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন