এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালেই কলেজপড়ুয়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমানের বিয়ে হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বেগম খালেদা জিয়া দুই সন্তানসহ গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার সংহতি ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
পরবর্তীতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে শহীদ হন।
সে সময় খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা। জিয়াউর রহমানের পরে দলের হাল কে ধরবেন সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। বছরখানেক যেতে না যেতেই নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় প্রশংসা অর্জন করেন। পরের বছর মার্চে তিনি দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদোন্নতি পান।
১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত, আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। বিগত কিছুকাল যাবৎ আমি বিএনপির কার্যক্রম গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। দলের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হতে পারে, এমন মনে করে আমাকে দলের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তাই দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিতে যোগ দিয়েছি ও দলের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং শহীদ জিয়ার গড়া দলে ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়া আমার লক্ষ্য।’
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হলে তিনি ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়ারপারসন পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির চেয়ারপারসন হন।
বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন খালেদা জিয়া। দল ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো রকম সমঝোতা না করেই আপসহীন আন্দোলন করে গেছেন। ফলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার ও ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
খালেদা জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় (সার্ক) দুবার চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে- পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই তিনিই জয়ী হয়েছেন।
সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সব কটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকার করেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। তার অভিযোগ, বলপ্রয়োগে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি ওই বাড়িটিতে ২৮ বছর ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার সেনানিবাসের বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছিল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তার সাজা হয়েছিল। গত ৬ আগস্ট সরকারের নির্বাহী আদেশে তার সাজা মওকুফ করা হয়। একই সঙ্গে গত ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি খালাস পান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার বিরুদ্ধে আপিলের ওপর শুনানি চলছে। সাজা মওকুফের পরও কেন আপিলের উদ্যোগ এমন প্রশ্নে তার আইনজীবীরা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি এসব মামলা আইনিভাবে মোকাবিলা করে খালাস পেতে চান।
রাজনীতিতে যোগ দিয়েই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবারের বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশ ছাড়ার জন্য চাপ থাকলেও দেশ ছাড়েননি তিনি। এরপর বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। জেলও খাটতে হয়েছে তাকে। কিন্তু আপস করেননি।
কারাগারে থাকাবস্থায় খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা। আওয়ামী লীগ আমলে তাকে মুক্তি দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য বিএনপি ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার আবেদন জানানো হলেও তাতে সরকার সাড়া দেয়নি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাকে মুক্তি দেন। মুক্তি পাওয়ার পর পরিবার ও তার দল বিএনপি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে।