মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ১১:৩১:০৪

সুন্দরবন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?

সুন্দরবন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় বঙ্গীয় সমতলকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের চারটি অংশে রয়েছে চারটি বিশেষ ভূতাত্বিক গঠন এবং বাঙালীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। এই সমতলের উত্তর পশ্চিম অংশে অবস্থিত বরেন্দ্র ভূমি বাঙালী সংস্কৃতির আদি পীঠস্থান। বাংলার আদিকালের রাজধানী গৌড় ও পুন্ড্র নগরীকে কেন্দ্র করে এই অংশে বাংলার অতীত সভ্যতার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারা উত্তরবঙ্গে, যার বিস্তার পশ্চিমে পান্ডু রাজার ঢিবি থেকে পূর্বে ওয়ারী বটেশ্বর পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায়। বাংলার উত্তর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে হাওর এলাকা। আমরা যে মাছে ভাতে বাঙালী, এই বিশেষ পরিচয়ের মূল ধারক ও বাহক এই হাওর এলাকা। কিছু পাহাড়ী জাতের মাছসহ বাংলার সকল প্রজাতির মিঠা পানির মাছ এখানে পাওয়া যায় এবং সেখানে বাৎসরিক পরিক্রমায় মাছের প্রজনন অব্যাহত আছে। বাংলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে সুন্দরবন। নদীর মিঠা ও সাগরের লোনা পানির মিলনস্থলে এই প্যারাবন একসময় বাংলার সারা বদ্বীপ জুড়ে ছিলো, পশ্চিমে সাগর দ্বীপ থেকে পূর্বে সন্দ্বীপ পর্যন্ত। বাংলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী ভূমি, ময়নামতির ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে নানা জাতির মানুষের বাস। নদী ও সাগরের মিলনস্থলে জলজ জীবের বৈচিত্র, স্থলজ জীব ও গাছপালার বৈচিত্র, এবং বাঙালীসহ নানা জাতের মানুষের বৈচিত্রে পূর্ণ বাংলায় রয়েছে মৌসুমী বায়ূ প্রভাবিত ছয়টি ঋতুর বিশেষ প্রকৃতি।

বাংলার এই সমতল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রকৃতির নিয়মে এই কথাই বলে যে, আকারে ছোট কি বড়, ভূপৃষ্ঠের কোন জীব বা প্রজাতি সেখানেই উত্তমভাবে পরিবৃদ্ধি করবে যেখানে তার বসবাস ও খাদ্যের জন্যে সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। পৃথিবীতে বাংলা বা বাঙ্গালাই সেই ভূমি যেখানে মানুষের জন্যে সেসব আছে, তাই এখানেই মানুষ সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় বাস করে। অনেকে কাশ্মীর বা সুইজারল্যান্ডে গিয়ে ভূস্বর্গ খোজেন, কিন্তু ইবনে বতুতা এই বাংলায় এসে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ ভূস্বর্গ দেখেছিলেন। এখানকার মানুষ আধপেটা খেয়ে আর অতি অল্প পরিসরে শুয়ে বসেও অত্যন্ত সুখের সাথে সন্তান উৎপাদন করতে পারে। তবে আগে একটা প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ছিলো। প্রতিবছরই কোন না কোন মহামারী এসে লোকসংখ্যা কমিয়ে দিতো। শিশুমৃত্যু হতো ব্যাপক। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও যারা জন্মেছে, তাদের ৮০ শতাংশই শিশু অবস্থাতে মরে গেছে। সারা বিশ্বেই এটা হতো। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মহামারীরোধক টিকা আবিষ্কার হলে ব্যাপকহারে শিশুমৃত্যু বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাংলার মানুষরা আগের মতই সন্তান উৎপাদন করতে থাকে, ফলে দু’তিন দশকের মধ্যেই জনসংখ্যা বেড়ে যায় তিন চার গুন। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো এসেছে তার পরে। ফলে জনসংখ্যার চাপে প্রাকৃতিক ভারসাম্য উল্টে গিয়ে বাংলা এখন নরকে পরিণত হয়েছে।
ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতাব্দীতে (১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে) বাংলায় এসে একে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নরক দেখেছিলেন। এই নরক ছিলো সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও শোষণের কারণে। শত শত বছর ধরে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও ইউরোপের দস্যুরা বাংলার সম্পদ, দাস ও নারী লুট করে নিয়ে গেছে। একসময় মগরাও নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলার প্রকৃতি আগের মতই সুজলা সুফলা থেকেছে। বাংলার মানুষ যখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে হাজার বছরের শোষণ থেকে মুক্ত হবার জন্যে মানবাধিকার নিয়ে জেগে উঠছে, বাংলার প্রতিভাবান মানুষরা যখন বাংলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব মানবকে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছে, তখনই তাকে দেয়া হল ধর্মীয় ভেদাভেদের মন্ত্র। যা’ হবার তাই হল, বাংলার মানুষরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, বাংলা ভাগ করে, সর্বস্ব অন্যের হাতে তুলে দিয়ে ভিখিরী হয়ে গেল। এরপর শুধুই অধঃগতি, আজ বাংলার প্রকৃতি শেষ, খাল বিল নদী নালা শেষ, গরু ছাগল মাছ পাখী শেষ, এমনকি বাংলার গাছপালা ফল শস্যও শেষ। আছে হাইব্রিড ধান, হাইব্রিড মাছ, হাইব্রিড ফল; এসবে খেয়ে বাঙালী বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু নানা ধরনের রোগে ভোগে, বাঙালীর বৈধ অবৈধ উপার্জনের সিংহভাগ যায় তার চিকিৎসায়। কিন্তু হাইব্রিড সংস্কৃতির সুফল পায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা বহুজাতিক কোম্পানীরা। তাদের দালালরা বাঙালীকে পরামর্শ দেয় ঋণ করে বেঁচে থাকতে। রাজনৈতিক নেতারা গালভরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সেবার পরিবর্তে তাদের সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত থাকে।

এরকমই এক গালভরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাগেরহাটের রামপালে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের কিছু ক্ষতি হবে, কিন্তু বিদ্যুতকেন্দ্রটি নির্মাণ করা থেকে পিছিয়ে আসার পথ নেই (বিডিনিউজ২৪.কম ১৫.০২.১৬)। আমাদের প্রশ্ন কেন নেই? এই ক্ষতির কথা তো আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। আমরা বলছি, কেন্দ্রটি মারাত্মক বায়ূদূষণ করবে, মিঠা ও লোনা পানির ভারসাম্য নষ্ট হবে, জাহাজ চলাচলের কারণে বর্জ্য ও শব্দদূষণ হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি; ফলে সুন্দরীসহ সুন্দরবনের গাছপালা ধ্বংস হবে, বাঘ ও অন্যান্য স্থলজ প্রাণীরা বাসস্থান হারাবে, মাছেরা লোপাট হবে, পাখীরা থাকতে পারবে না। বাংলাদেশে সুন্দরবন প্রকৃতির শেষ নিদর্শন। সুন্দরবন শেষ হলে বাংলাদেশ শেষ হবে। তা’ কি আমরা হতে দিতে পারি?   
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস  

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে