শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৬:৫৭:০৮

মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গুলির চিহ্ন, শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ ২৫০টি গুলি!

মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গুলির চিহ্ন, শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ ২৫০টি গুলি!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গুলির আঘাতের চিহ্ন। শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ হয়ে আছে ২৫০টি গুলি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলি চোখে ও মাথায় নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। চিকিৎসকেরা তার শরীর থেকে ২০টি গুলি বের করেছেন।

দুই দুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে শরীরে। এখনও অসহনীয় ব্যথায় ছটফট করছেন তিনি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য মাইনুদ্দিনের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। নয়তো হারাতে পারেন তার দৃষ্টিশক্তি।

এদিকে আছেন অর্থকষ্টে। অসুস্থ হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। এখন জরুরি ভিত্তিতে তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু এ উদ্যোগ নেয়ার আর্থিক সামর্থ্য তার পরিবারের নেই।

 নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন তার বৃদ্ধ বাবা রুহুল আমিন (৮০) ও মা ফিরোজা বেগমকে (৭০) নিয়ে বসবাস করেন। দুই বোন বিবাহিত। কয়েক বছর আগে স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে মা-বাবাকে নিয়েই তার সংসার।জীবনের সেই ভয়াল দিনটি স্মরণ করে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।

তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। তবুও সেদিন ঘরে থাকতে পারিনি। গত ৫ আগস্টের দিন সকালে, আমি বাবা-মার চোখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হই। সাথে ছিল আমার বন্ধু হিজবুল্লাহ। মৌচাকের কাছাকাছি এসে একটা মিছিলের সাথে একত্রিত হই। সেখানে প্রায় হাজার মানুষ।

কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি এদের চিনি না। মনে হয়েছে, ভাই ভাই আমরা, প্রত্যেকটি মানুষকে চিনি। শনিআখরার ঢালে যাওয়ার পর যা দেখি তাতে শরীরের রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক রক্তাক্ত লাশ নিয়ে মানুষ হাসপাতালে যাচ্ছে। যাত্রাবাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার কাছে যাওয়ার পর, পুলিশ আমাদের মিছিল আটকে দেয়।

এরমধ্যে একজন পুলিশ হ্যান্ড মাইকে আমাদেরকে ডাকে, বুঝলাম কথা বলার জন্য ডাকতেছে। ভয়ে কেউ যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। ভাবলাম কি বলবে শুনি, না গেলে যদি গুলি শুরু করে, তাহলে সবাই মারা যাবো। আমার ভাইগুলোর কথা ভেবে পুলিশদের দিকে হাঁটা শুরু করি। আমাকে দেখে সাদা টিশার্ট পরা একটা স্কুল পড়ুয়া ছেলে আমাকে বলে, ভাইয়া আমিও আপনার সাথে যাবো। বললাম, গেলে তো গুলি খেতে পারো।

ছেলেটা বলল, ‘গুলি খাওয়ার জন্যই তো এসেছি।’ ও আমার পেছন পেছন আসে। ৮-১০ফিটের দূরত্বে যখন পৌঁছে যাই, তখন তাদের মধ্যে একজন বলে, গুলি কর। সত্যিই পুলিশ গুলি করে। গুলি করার সাথে সাথে  আমি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখি পুরো শরীরের গরম রক্তে শার্ট ভিজে গেছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওদেরকে তখন বলেছিলাম, ‘তোদের সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।

ধোঁকা দিয়ে গুলি করেছিস, তোদের পতন নিশ্চিত।’ এটা বলে পিছনে ফিরে যেতেই আরেকটা ধাক্কা খেলাম। ১০০ গজ দূরে সাদা টিশার্ট পরা ছেলেটা মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ওরে শটগানের গুলি করা হয়েছিল। আমি ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রক্তবমি শুরু হয়। আমি আর সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। পরে কয়েকজন আমাকে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে নেয়। পরিস্থিতি গুরুতর হলে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। 

আহত মাইনুদ্দিন বলেন, হাসপাতালে থাকা অবস্থায় একজন ডাক্তার বলল আপনার রক্ত দেওয়া সার্থক, ফ্যাসিবাদ ভাগছে। মুহূর্তেই সব ব্যথা ভুলে যাই, অদ্ভুত একটা স্বস্তি কাজ করে। এরমধ্যে আমার বাবা আমার গুলি লেগেছে শুনে হার্ট অ্যাটাক করেন। তিনি এখন সুস্থ আছেন। আমি আব্বার খেয়াল কি রাখব, তিনিই আমার খেয়াল রাখেন।

গুলশানের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মাইনুদ্দিন। ৫ আগস্টের পর হারিয়েছেন তার চাকরি। বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাকরির দায়িত্বের জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকে আন্দোলনে যেতে পারিনি। কিন্তু ৪ আগস্ট আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। অফিস থেকে দুপুরের খাবারের আগে ছুটি চাইলাম। প্রথমে তারা ছুটি দিতে চায়নি। পরে অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছি বলে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে ছুটি দেয়।

আমি শাহবাগ অবস্থান থেকে আন্দোলনে যুক্ত হই। আমার কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা নেই। সাধারণ জনতার সাথে মিলে আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু আহত হওয়ার পর থেকে আর চাকরি করার অবস্থায় ছিলাম না। চাকরি নেই। এখন বাসায় বেকার আছি। পুরোপুরি সুস্থ হলে যদি কোনো চাকরি হয় আরকি, সেই আশায় আছি। 

তিনি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা জানান। 

মাইনুদ্দিনের মা ফিরোজা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে আক্ষেপ করে বলেন, আমার পোলায় মৃত্যুকে হারাইয়া আমাগো কাছে ফিরেছে। এই পোলায় আমাগো বুড়া-বুড়িরে দেখে। চিকিৎসার অভাবে সেই পোলা এখন রাইতে ছটফট করে ব্যথায়। বুড়া বয়সে ওরে এখন আমাগো খেয়াল রাখতে হয়। আমার পোলাডার চাকরি গেছে গা, ওর শরীরের এই অবস্থা! আমাগো কি হইবো আল্লায় জানে।-বাসস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে