শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৮:৫১:৫৮

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার সুপারিশ করছে সংবিধান সংশোধন কমিশন

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার সুপারিশ করছে সংবিধান সংশোধন কমিশন

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার সুপারিশ করছে সংবিধান সংশোধন কমিশন। এ সংক্রান্ত বিদ্যমান ধারাটি হুবহু রাখার কথাই বলা হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’ বহাল থাকছে, তবে এক্ষেত্রে বাংলা অনুবাদে পরিবর্তন এনে ১৯৭৯ সালের পঞ্চম সংশোধনীর অনুবাদ পুনর্বহাল করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন কমিশন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংশোধন কমিশন গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরে ওইদিন বিকালে প্রতিবেদনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।

কমিশনের প্রকাশ করা সারসংক্ষেপে সুপারিশের নানা দিক উল্লেখ করা হলেও রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত সংবিধানের ধারার (২ক) বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারসংক্ষেপে রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কিত ধারার বিষয়ে সুপারিশ না করা হলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের কথা রয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ ইস্যুতে তাদের প্রায় সব সদস্য একমত হয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারলেও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে। কমিটির একজন সদস্য জানান, স্পর্শকাতর এ ইস্যুটি নিয়ে কমিশনের সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। কমিটির একাধিক প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে ওই সদস্য জানান। পরে ভোটাভুটির মাধ্যমে এর সুরাহা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামত এলে সেটাকে চূড়ান্ত করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি ছিল না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নতুন ২ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করা হয়। ওই সংশোধনীটি ছিল এমনÑ ‘রাষ্ট্রধর্ম। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’

তবে নবম জাতীয় সংসদে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ওই সময় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হলেও এ ধারায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। ওই সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীন ধর্ম পালনের গুরুত্বারোপ করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করে বলা হয়Ñ‘রাষ্ট্রধর্ম ২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’

জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে থাকা বিসমিল্লাহ.. বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। এখানে কেবল বানানটি ‘শুদ্ধ’ করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’-এর পরিবর্তে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রাহিম’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে ২০১১ সালে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’-এর যে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে, সেটা পরিবর্তন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় থাকার সময় আনা পঞ্চম সংশোধনীর অনুবাদ পুনর্বহাল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় অনুবাদ করা হয়েছিলÑ ‘(দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’) সংস্কার কমিশন তার অনুবাদে কেবল ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে’ রাখার সুপারিশ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, কমিশনের এক সদস্য বলেন, পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযুক্ত করার সময় যে অনুবাদ করা হয়েছিল, কমিশন সেটা পুনর্বহালের সুপারিশ করেছে। এ সদস্য যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘আল্লাহর কোনো অনুবাদ হয় না। সৃষ্টকর্তা শব্দ দিয়ে আল্লাহকে বোঝানো যায় না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আমাদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি। এর বাইরে আপাতত কিছু বলতে চাই না। আপনারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের পুরো বিষয়টি দেখতে পাবেন।’

১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। জিয়াউর রহমানের সময় পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন এনে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বিধানটি যুক্ত করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ‘… আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বিধান বাদ দিয়ে আবারও ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্ত করেছিল। ড. আলী রীয়াজের কমিশন তার সুপারিশে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধানটি বাদ দিয়েছেন। তবে আল্লাহর ওপর আস্থা, বিশ্বাস যুক্ত করেনি। কমিশন তার সুপারিশে বিদ্যমান চারটি মূলনীতির পরিবর্তে পাঁচটি মূলনীতি রাখার সুপারিশ করেছে। তাদের সুপারিশ হচ্ছে—সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন—এই দুটি সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে নারী আসন ১০০টি করার সুপারিশ করা হলেও নারী আসনের নির্বাচন নিয়ে তারা দুই ধরনের সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে সংসদের বিদ্যমান ৩০০টি সাধারণ আসনের আদলে দেশকে ১০০টি নির্বাচনি এলাকায় বিভক্ত করে ওই নির্বাচনি এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন বলে সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। অপরদিকে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করার সুপারিশ করেছ। এক্ষেত্রে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনের ১০০টি আসনে প্রতিটি দল কেবল তাদের নারী সদস্যদের মনোনয়ন দেবে। ওই আসনগুলোতে কোনো পুরুষ সদস্য ভোট দিতে পারবেন না। পরের সংসদ নির্বাচনে ওই আসনগুলো বাদ দিয়ে অন্য ১০০টি আসন নির্ধারণ করা হবে। এভাবে চার টার্ম পর পুনরাবৃত্তি হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে নির্বাচনি এলাকা দুইভাবে ভাগ করলে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব হবে। এ বিষয়টি পরিহার করতে আমরা এই সুপারিশ করেছি। ভারতের একটি রাজ্যে এ ধরনের বিধান রয়েছে।’

সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা উভয় কমিশন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) ভোটে রাষ্ট্রপতি ভোটের কথা বললেও তারা দুই ধরনের নির্বাচনমণ্ডলীর সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশন আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য, ৬৪টি জেলা সমন্বয় কাউন্সিলের একটি করে ৬৪ ভোট, প্রতিটি সিটি করপোরেশন কাউন্সিলের একটি করে ভোট থাকবে বলে সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিধান করার কথা বলেছে।

এ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর কথা বলেছি। স্থানীয় সরকারের সব প্রতিনিধিকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করলে আমরা অর্ধলক্ষাধিক নির্বাচকমণ্ডলী পাব।’

এদিকে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থা—দুটি কমিশনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছে। এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের কথা বলেছে ৯০দিন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন চার মাস মেয়াদের কথা বলেছে। ইসি সংস্কার কমিশন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছে।

উল্লেখ্য, সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন একই ধরনের ইস্যুতে অভিন্ন সুপারিশ তৈরির জন্য নিজেদের মধ্যে একাধিক সমন্বয় সভা করেছিল। অভিন্ন ইস্যুতে সুপারিশে দেওয়ার বিষয়ে তারা সমন্বয় করার কথা তখন গণমাধ্যমকেও জানিয়েছিল।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে