বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৪৪:১২

বিএনপি ঘাটে ঘাটে টাকা দিচ্ছে

বিএনপি ঘাটে ঘাটে টাকা দিচ্ছে

নিউজ ডেস্ক : সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ৩ নম্বর সরুলিয়া ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বদরুজ্জামান মোড়ল। তাকে বাদ দিয়ে উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক এক সংসদ সদস্য যোগসাজশ করে এক অভিযুক্ত ব্যক্তির  হাতে ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বদরুজ্জামান মোড়লের অভিযোগ, ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউপি প্রার্থী বদল করা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য পেয়েছেন ২০ লাখ আর উপজেলা সভাপতি পেয়েছেন ৫ লাখ। একই অবস্থা পাশের ইসলামকাটি ইউনিয়নেও। বারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লোকমান হোসেনকে বাদ দিয়ে আরেক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। মাগুরা ইউনিয়নেও জনপ্রিয় নেতা অধ্যাপক আবু সাইদকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। সেখানেও বেশ কয়েক লাখ টাকা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।

তবে সাবেক ওই সংসদ সদস্য বলেন, ইউনিয়ন ও উপজেলার পাঁচজন নেতার মতামতের ভিত্তিতেই প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সবই ‘মিথ্যা’। বদরুজ্জামান মোড়ল সব সময় নেশায় অভ্যস্ত। নেতা-কর্মীরা এ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। মনোনয়ন না পেয়ে উল্টাপাল্টা বলছেন।   

জানা যায়, শুধু সাতক্ষীরার ওই তিন ইউনিয়নই নয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশেই বিএনপিতে ঘাটে ঘাটে মনোনয়ন বাণিজ্য হচ্ছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর। আবার দায়িত্বের বাইরে থাকা কেন্দ্রের প্রভাবশালী গুটিকয়েক নেতার বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ আছে। কয়েকটি এলাকায় বিএনপির ত্যাগী নেতা ও নির্বাচিত চেয়ারম্যান বাদ দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীকেও ধানের শীষের প্রতীক তুলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ইউপি নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘তৃণমূলের সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্র থেকে মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করা হচ্ছে। স্বচ্ছ উপায়ে খোঁজখবর নিয়েই চেয়ারম্যান পদে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হচ্ছে। এখানে আর্থিক লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে তাহলে দলীয় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে কোনো নেতাই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন।’

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদেই দলীয় সাবেক এমপি ও স্থানীয় উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহ শহীদ সারোয়ারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।

আগামী ২২ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে পাঁচ লাখ থেকে অর্ধকোটি টাকা পর্যন্ত এ সাবেক এমপি মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ তাদের। এ ঘটনার প্রতিবাদে একটি ইউনিয়নে দলটির নেতা-কর্মীরা গণপদত্যাগ করেছেন। জানা যায়, ৫নং ফুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন মাদিউর রহমান মাহাদি। অথচ স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপি মনোনীত করেছিল তিনবারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান খোকাকে।

মনোনয়ন বঞ্চিত মোস্তাফিজুর রহমান খোকা বলেন, ‘সারোয়ার টাকা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রীর ছেলের কাছে বিএনপির মনোনয়ন বিক্রি করেছেন। প্রায় সব ইউনিয়নেই তিনি মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন।’ ৬নং পয়ারী ইউনিয়নে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। তার বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন গত নির্বাচনে তৃতীয় হওয়া মফিদুল ইসলাম। এখানে মোটা দাগের অংকের লেনদেন হয়েছে অভিযোগ দেলোয়ারের।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও তারাকান্দা উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন তালুকদার বলেন, ১০টি ইউনিয়নেই কোটি কোটি টাকা নিয়ে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন সারোয়ার। আর এ কারণে দলের যোগ্য, নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তারা ক্ষোভের অনলে পুড়ছেন। একই রকম অভিযোগ করেন উত্তর জেলা বিএনপির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও ফুলপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল বাশার আকন্দ।

নওগার পত্নীতলা থানার ১১টি ইউনিয়নে দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ নির্বাচন। ওই নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির নওগাঁ জেলার সাবেক সভাপতি শামসুজ্জোহা খান প্রকাশ্যে আর্থিক লেনদেন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই এলাকায় নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে নতুন করে ইউনিয়ন কমিটি করে প্রার্থী দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য টাকার বিনিময়ে নিজের পকেটের লোকদের মনোনয়ন দেওয়া।

জানা যায়, ১০ নম্বর আনাইড় ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রকীব, ৬ নম্বর কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুস সামাদ, নির্মইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতাউর রহমান, দিবর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শেখ, নজিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান মিন্টু, ১১ নম্বর শিহাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নওশাদ আলীকে বাদ নিয়ে সম্প্রতি নতুন করে ইউনিয়ন কমিটি করা হচ্ছে।

এই নেতাদের কারও কারও কাছে টাকাও দাবি করা হয়েছে। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় নিজের মতো করে ইউনিয়ন কমিটি করা হয়েছে। পদবঞ্চিত নেতারা ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বিষয়টি লিখিত অভিযোগ আকারে তুলে ধরেছেন। পরে এ বিষয়টি দেখবালের জন্য রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।  

এ প্রসঙ্গে পরপর তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুর রকীব বলেন, গত নির্বাচনে নওগাঁ জেলায় আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। আমি সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছি। তারপরও আমি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। নেতা-কর্মীরাও আমার পাশে। কিন্তু প্রকাশ্যেই শামসুজ্জোহা খান ও তার স্ত্রী পলি বেগম আর্থিক লেনদেন করে আমাকে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করছেন। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার জামাল কামাল নুরুদ্দিন মোল্লা আলাদাভাবে চেয়ারম্যানের তালিকা কেন্দ্রে পাঠান।

চূড়ান্ত তালিকা করার আগে দুজনকে নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মো. শাহজাহান কয়েক দফা বৈঠক করেন। শিবচরের ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে প্রথমে দুই গ্রুপকে সমানভাবে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু নুরুদ্দিন মোল্লা তা মানেননি। কেন্দ্রের মনিটরিং টিমের কয়েকজন সদস্যকে ম্যানেজ করে ১০টি ইউপিতে তার সমর্থকদের মনোনয়ন নিশ্চিত করেন। নুরুদ্দিন মোল্লাকে ১০টি ও মিঠু চৌধুরীকে ৬টি চেয়ারম্যান পদ দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেককে প্রত্যয়নপত্রও দেওয়া হয়। ১০টি চেয়ারম্যান মনোনয়ন পাওয়ার পরও থেমে থাকেননি নুরদ্দিন মোল্লা।

বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ম্যানেজ করেন তিনি। মিঠু চৌধুরী গ্রুপের পাওয়া ছয়টি চেয়ারম্যান পদ থেকে দুটি নুরুদ্দিন মোল্লার সমর্থকদের দেওয়া হবে বলে ওই দুই নেতা নিশ্চিত করেন। ওই দুই নেতা দুটি ইউনিয়নের দুটি প্রত্যয়নপত্র প্রিন্ট করেন। পরে তা নিয়ে যান দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি দুটি প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করে দেন।

শিবচরের বাঁশকান্দি ইউপিতে মো. শাহিন মিয়া ও কাঁঠালবাড়িতে আবদুস সালাম শেখকে প্রথমে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। তারা মিঠু চৌধুরীর সমর্থক। পরে ওই সিন্ডিকেটটি নুরুদ্দিন মোল্লার সমর্থক কাঁঠালবাড়িতে আলতাফ হোসেন বেপারি ও বাঁশকান্দিতে শহীদকে প্রত্যয়ন দেন। সোমবার দুই ইউপিতে বিএনপির দুজন করে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ওই সিন্ডিকেটটি প্রত্যয়নের সঙ্গে একটি চিঠিও রিটার্নিং কর্মকর্তার বরাবর দেন।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৬ নম্বর মাগুরাগোনা ও ৭ নম্বর শোভনা ইউনিয়নেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের নেতারা যে প্রার্থীর সুপারিশ করেছিলেন উপজেলা নেতারা তা পাল্টে ফেলেন। সেখানে আর্থিক অনিয়ম হয়। মাগুরাগোনায় বিএনপির উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটির নেতারা আবুল কালাম শামসুদ্দিনের নাম সুপারিশ করে জেলায় পাঠান।

শামসুদ্দিন ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি খুলনার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু জেলার নেতারা তা পাল্টে নজরুল ইসলামের নাম সুপারিশ করেন। মাদারীপুরের শিবচরে দুটি, পিরোজপুর জেলার দুটি ও পটুয়াখালীর একটি ইউনিয়নে দুজনকে ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ‘দু-চারটি ইউনিয়নে ভুলক্রমে একাধিক প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য কেন্দ্র থেকে নতুন চিঠির মাধ্যমে তা সংশোধন করে নেওয়া হয়েছে।’ -বিডি প্রতিদিন
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে