সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৪:১৮

খাতুনগঞ্জে এবার উল্টোচিত্র, আমদানি বাড়ায় কমেছে দাম

খাতুনগঞ্জে এবার উল্টোচিত্র, আমদানি বাড়ায় কমেছে দাম

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, চট্টগ্রাম : রমজানের পণ্যে বোঝাই এখন দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এ সময় বাড়তি চাহিদা মেটাতে আগেভাগেই বিপুল পরিমাণে পণ্য আমদানি হয়েছে। 

বিশেষ করে চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, মটর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও খেজুরের বাড়তি চাহিদা মেটাতে রোজা শুরুর তিন-চার মাস আগে থেকেই এসব পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। রোজার আগে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। আর আমদানি বেশি হওয়ায় দামও কমেছে বলে জানা গেছে। 

চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা বলছেন, সরকার অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে শুল্কায়ন করায় খেজুরের আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে দাম কমেছে। তবে বোতলজাত ভোজ্য তেলের সরবরাহ কিছুটা কম।

কম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবছর রোজার এসব পণ্য সংকটের অজুহাতে বাড়তি দাম নিয়ে ভোক্তার পকেট কাটতেন ব্যবসায়ীরা। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন অভিযান চালালে বাধ্য হয়ে ২-৩ শতাংশ কমাতেন। কিন্তু এবারের চিত্র পুরোটায় উল্টো।

রোজার ভোগ্যপণ্য এবার ৩১ শতাংশ বাড়তি আমদানি হওয়ায় বাজারে ভোজ্য তেল ছাড়া বাকি সব পণ্যের দাম ভোক্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রোজা শুরু হতে পাঁচ দিন বাকি। এর মধ্যে ক্রেতার দেখা নেই। আগে পণ্যের সংকট হতো, এখন ক্রেতার সংকট।

চটগ্রাম বন্দরের আমদানি তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, মটর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও খেজুর বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গড়ে ৩১ শতাংশ।

এ ৯ পণ্য আমদানি হয়েছে ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ১৫ টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ১৭৫ টন। এবার আমদানি বেড়েছে চার লাখ ৬০ হাজার ৮৪০ টন। এর মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। গতবার ছিল দুই লাখ ৭৯ হাজার ৩২৪ টন। এবার আমদানি দুই লাখ ৮৭ হাজার ৭৩০ টন। বেড়েছে আট হাজার ৪১৬ টন। রসুন এবার ১২ হাজার ৭২ টন বেশি আমদানি হয়েছে। শতকরা হিসাবে ২২ শতাংশ। গতবার আমদানি ছিল ৫৭ হাজার ৭৩ টন। এবার ৭০ হাজার ৪৩২ টন। আদা আমদানি হয়েছে ৫৩ হাজার ৫২৮ টন। গতবার ছিল ৩৩ হাজার ৮৭৭ টন। এবার ১৯ হাজার ৬৫১ টন বেড়েছে; যা ৫৮ শতাংশ।

চিনি আমদানি হয়েছে চার লাখ ৬০ হাজার ৪৮ টন। গতবার ছিল তিন লাখ ৮০ হাজার ২০৬ টন। এবার ৭৯ হাজার ৮৪২ টন বেড়েছে; যা ২১ শতাংশ। সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ ৯৯ হাজার ৫২১ টন। গতবারের তুলনায় এবার এক লাখ ৫৫ হাজার ৪৩১ টন বেড়েছে; যা ৩৫ শতাংশ বাড়তি। গতবার ছিল চার লাখ ৪৪ হাজার ৯০ টন। খেজুর আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৫২১ টন। গতবার ছিল ১২ হাজার ৪১৭ টন। এটিও ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

ডালজাতীয় পণ্যের মধ্যে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৭৩০ টন। গতবার ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৪৮৫ টন। বেড়েছে ৪৯ হাজার ২৪৫ টন; যা ৪৫ শতাংশ। ছোলার আমদানি এবার ৯৮ হাজার ৬৩০ টন। গতবার ৫৯ হাজার ৭১৫ টন আমদানি হয়েছিল। এবার ৩৮ হাজার ৯১৫ টন বেশি আমদানি হয়েছে। শতকরা হিসাবে ৬৫ শতাংশ। মটর ডালের আমদানি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এবার ৮৫ শতাংশ বাড়তি আমদানি হয়েছে। এবার দুই লাখ দুই হাজার ৮৭৫ টন আমদানি হয়েছে। গতবার ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৩৩১ টন। এবার বেড়েছে ৯৩ হাজার ৫৪৪ টন।

গতকাল রবিবার সকালে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, নিত্যপণ্যবাহী একের পর এক ট্রাক প্রবেশ করছে আড়তে। শ্রমিকরা ট্রাক থেকে পণ্যগুলো আড়তে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। প্রতিটি আড়তে এখন পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ছোলা, মটর ডাল, মুগডাল, মসুর ডালের বস্তায় পরিপূর্ণ। তবে ক্রেতা দেখা গেছে কয়েকজন। অথচ গত কয়েক বছর রোজার শুরুর ১০-১৫ দিন আগে থেকে খাতুনগঞ্জে ক্রেতাদের ভিড় থাকত চোখে পড়ার মতো। এবার ক্রেতা সংকটে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জে পাইকারি বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৯২ থেকে ১১০ টাকা। ১৫ দিন আগে প্রতি কেজিতে ১৮ টাকা পর্যন্ত কম ছিল। মটর ডাল প্রতি কেজি ৫৬ টাকা, মুগডাল ১২৫ টাকা ও মসুর ডাল ৯৭-৯৮ টাকা। ছোলার দাম বাড়লেও বাকি ডালগুলোর দাম এক সপ্তাহ ধরে একই রয়েছে।

পেঁয়াজের মধ্যে মেহেরপুর অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০-২৫ টাকা, দেশি ৩০-৪০ টাকা এবং ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা। দেশীয় পেঁয়াজের দাম কমলেও সপ্তাহ ব্যবধানে ভারতীয় পণ্যটির দাম কেজিতে বেড়েছে ১১ টাকা পর্যন্ত। আদার মধ্যে কেরালার পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১০৫ টাকা। এটির দাম ১২-১৫ টাকা বেড়েছে। চায়না আদা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা। এটির দাম এক সপ্তাহ ধরে স্থিতিশীল রয়েছে। রসুনের মধ্যে চায়না পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা। দেশি ১০০ টাকা। পণ্যটির দাম কেজিতে চার থেকে সাত টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

তবে বেশির ভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। কম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। যাদের তেল আছে তারা পাঁচ লিটার বিক্রি করছে সাড়ে ৯০০ টাকার ওপরে। কিছু কিছু দোকানে দুই লিটারের বোতল ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এক লিটারের মূল্য ১৯৫-২০০ টাকা। খাতুনগঞ্জের খোলা তেলের আড়তদার বশির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পর্যাপ্ত আমদানি হলেও মিলাররা সরবরাহ করছেন চাহিদার মাত্র ৫-৭ শতাংশ। ফলে বাজারে এখন তেলের সংকট। বোতলজাত তেল তো পাওয়ায় যাচ্ছে না, এমনকি খোলা সয়াবিন তেলও মিলছে কম।

খাতুনগঞ্জের খোলা চিনির ডিলার কামাল উদ্দিন বলেন, চিনি আমদানিও স্বাভাবিক। এ ছাড়া দেশেও চিনি উৎপাদনের ভর মৌসুম চলছে। সরকারি চিনিকলগুলোও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা। এটি আগে ছিল ১২৩ টাকা। এখন পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় কেজিতে আট টাকা কমেছে। এর পরও ক্রেতা নেই।

এদিকে রমজানের আগেই কমতে শুরু করেছে খেজুরের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে প্রতি কেজি খেজুরের দাম কমেছে সর্বোচ্চ ৪৩০ টাকা পর্যন্ত। চট্টগ্রামে ফলের পাইকারি বাজার ফলমণ্ডির একাধিক ব্যবসায়ীর তথ্য মতে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মাবরুম (সৌদি আরব) খেজুর বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকায়। যা এক মাস আগে ৪০০ টাকা বেশি ছিল। সৌদি আরবের আজোয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৩০ থেকে ৭৭০ টাকায়। এটির কেজিতে কমেছে ১৮০ টাকা। বর্তমানে মিসর থেকে আমদানি হওয়া প্রতি কেজি মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯২০-৯৫০ টাকায়। কমেছে ৪৩০ টাকা পর্যন্ত।

গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১৭০ টাকা কমে বর্তমানে প্রতি কেজি ইরাকি জায়েদি খেজুর ৩৫০-৩৭০ টাকা, ১৬০ টাকা কমে ইরাকি নাগাল ৫৬০-৫৭০ টাকা, ১৬০ টাকা কমে ইরাকি দাব্বাস ৭০০ টাকা ও তিউনিশিয়ার ছররা ১৪০ টাকা কমে ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে কম দামি বস্তা (নরম) খেজুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা। এটিতে কমেছে ৩৫ টাকা।

চট্টগ্রামের খেজুরের আমদানিকারক মোহাম্মদ জাহেদ বলেন, সরকার অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে শুল্কায়ন করায় খেজুরের আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে দাম কমেছে।

খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. ইদ্রিস আক্ষেপ করে বলেন, আড়তগুলো রোজার পণ্যে ভর্তি। এর পরও প্রতিদিন ভোগ্যপণ্যবাহী ট্রাক আড়তে প্রবেশ করছে। আড়তগুলোতে পণ্যের সংকট নেই। কিন্তু সময় অনুসারে ক্রেতা নেই।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সহসাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আজাদ বলেন, প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। পাইপলাইনেও প্রচুর ভোগ্যপণ্য রয়েছে। তেল ছাড়া বাকি পণ্যের জোগান পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে। 

তিনি বলেন, বাজারে গিয়ে হুড়াহুড়ি করে একই সঙ্গে পুরো মাসের পণ্য কেনার দরকার নেই। প্রচুর পণ্য আছে। পণ্যের কোনো ঘাটতি রমজানের শেষ দিনেও হবে না।-কালের কণ্ঠ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে