শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৬:২২:৫১

হাতে ফুল চোখে জল

 হাতে ফুল চোখে জল

নিউজ ডেস্ক : কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। পাশে তার দুই সন্তান। দুই হাত তুলে দোয়া করতে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠছিলেন তিনি। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে দুই সন্তানও।  এই দৃশ্য দেখে কান্না থামাতে পারেননি কেউই।  এই নারীর নাম ডা. রুহেনা মতিন।  বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ লে. কর্নেল ইনশাদের স্ত্রী তিনি।  পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সপ্তম বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল।

ইতিহাসের এই কলঙ্কিত দিনে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।  দিনটি উপলক্ষে রাজধানীর বনানীর সামরিক কবরস্থানে সকাল থেকেই ভিড় করতে থাকেন শহীদ স্বজনরা। তাদের অনেকের হাতে ছিল ফুল।  সবার চোখে অশ্রু।  সেখানে এক আবেগঘন দৃশ্য তৈরি হয়।  প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় কবরস্থানে।

একইভাবে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাহিনী প্রধানগণ। বিএনপির পক্ষ থেকেও শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।  এ সময় বিএনপি নেতৃবৃন্দ দাবি করেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের গোপন রহস্য এখনো উদ্ঘাটন হয়নি। তারা অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

নিহত মেজর মো. মিজানুর রহমানের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন তার বৃদ্ধ মা।  পাশে থাকা শিশুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রেলিংয়ের ওপারে থাকা কবরের দিকে।  পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা শিশুটি কাঁদছে না।  দাদির কান্নার দিকেও যেন তার খেয়াল নেই।  তার সমস্ত মনোযোগ কবরের দিকে।

বাবা কী, তা বোঝার আগেই ফারদিন রহমান সামিরের বাবা মিজানুর চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।  তারও আট মাস আগে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন মা।  তাই হয়তো কবরের দিকে তার এত মনোযোগ।  তবে মিজানুর রহমানের মা শোক আর স্মৃতিকাতর কহিনূর বেগমের কান্না থামছিলই না।  

কান্নার ফাঁকে ফাঁকে অস্ফুট স্বরে শুধু বলছিলেন, ‘বলে গেলো আসবে, আর আসলো না’।  কান্নার তীব্রতায় তার নুয়ে যাওয়া শরীর কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে।  নিহত কর্নেল কুদরত এলাহী রহমানের ছেলে সাকিব রহমান বলেন, প্রতি মুহূর্তে বাবাকে মনে পড়ছে।  সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন হোক বা অন্য কোনো মুহূর্ত।  বাবাকে হারানোর পরের ১০ দিন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ ১০ দিন।  

কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বোন দিলরুবা খাতুন।  সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা যা হারিয়েছি তা পূরণের নয়। আমরা এখন বিচার কার্যকর দেখতে চাই।

সকালে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমদ।

পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।  এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা স্যালুট প্রদান করেন।  পরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ মোহসিন রেজা জানিয়েছেন, দিনটি উপলক্ষে সকল সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআন খতমের ব্যবস্থা এবং শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

এতে সেনাবাহিনীর সকল স্তরের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।  এছাড়া আজ ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিকাল পৌনে ৫টায় পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদদের নিকটাত্মীয়রা, পিলখানায় কর্মরত কর্মকর্তা, সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।

সন্দেহ এখনও যায়নি কেন?

এদিকে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের সাত বছর পরও ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে অনেকের মনে সন্দেহ রয়ে গেছে।  বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআরের  সৈন্যদের নানা ক্ষোভের কারণে বিদ্রোহ হলেও ঘটনা দ্রুত ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে পরিণত হয়।  সৈন্যদের ক্ষোভ কীভাবে হত্যাকাণ্ডে পরিণত হলো, তার কোনো সদুত্তর না পেয়ে অনেকেই মনে করেন ওই বিদ্রোহ ছিল একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনটি তদন্ত, চার হাজারেরও বেশি বিডিআর সৈন্যের কারাদণ্ড এবং দেড় শ’র বেশি মৃত্যুদণ্ডও বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেনি।

বিদ্রোহ নিয়ে এই বিতর্কের কারণগুলো বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা কাদির কল্লোল, যিনি ওই ঘটনা শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করছেন। বিদ্রোহের খবর পেয়ে প্রথমে আমরা পিলখানার গেটের সামনে যাই।  তখন বাইরে থেকে শুধু গুলির শব্দ শুনছিলাম।  হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতা নিয়ে বিদ্রোহের প্রথমদিনে কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না।  দ্বিতীয় দিনে যখন জওয়ানরা আটকে রাখা সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দেয়, তাতে হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতার বিষয়টি প্রকাশ পেতে থাকে।

যখন একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, তখনই এই ঘটনার ভয়?াবহতা টের পাওয়া যায়? এবং এর উদ্দেশ্য নিয়েও নানারকম প্রশ্ন দেখা দেয়।  বিদ্রোহের ওই ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মারা যান।
যদিও বিদ্রোহের শুরুতে জওয়ানরা সেনাবাহিনী থেকে আসা তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিল, বাহিনীটি পরিচালিত ডাল-ভাত কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগও তারা তোলেন।

কিন্তু ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনা যখন বেরিয়ে আসে, তখন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথমে প্রশ্ন তোলেন।  তারা মনে করেন, এটা নিছক বিদ্রোহ ছিল না, এর পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল।  রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এসেছে।  আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা ক্ষমতা আসা মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে।  তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে বিদ্রোহ দমনে সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করায় বিরোধী দল বিএনপি শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিল। তাদের অনেকে সে সময় এই ঘটনার জন্য প্রতিবেশী ভারতের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া অব্যাহত রেখেছেন।  

তিনি অভিযোগ করে আসছেন, এটির পেছনে একটি ষড়যন্ত্র ছিল।  ফলে এই ঘটনার নেপথ্যের কারণ নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি সন্দেহ তৈরি হয়ে?ছে।  কিন্তু সাত বছর পরেও, যখন এই ঘটনার তদন্ত হয়েছে, বিচার হয়েছে, তখনো মানুষের মন থেকে সন্দেহ দূর হয়নি।  এ ঘটনার তদন্তে তিনটি কমিটি হয়েছিল।

সাবেক সচিব মো. আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি বিদ্রোহের জন্য বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছিল।  একইসঙ্গে কমিটি ঘটনার পেছনের কারণ বা নেপথ্যের কারণ তদন্তের সুপারিশ করেছিল।  

সেনাবাহিনীও একটি তদন্ত করেছে, যদিও তাদের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।  হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক মামলা তদন্ত করেছে সিআইডি পুলিশ।  বিদ্রোহের ঘটনায় বাহিনীটির নিজস্ব আইনে চার হাজারের বেশি জওয়ানের সাজা হয়েছে।  আর হত্যা মামলায় ফৌজদারি আইনে ৮০০ জনের মতো জওয়ানের সাজা হয়েছে, যেটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

কোনো মামলায় এত সংখ্যক আসামির সাজা বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। এর পরেও অনেকে এখনও সন্দেহ প্রকাশ করেন।  এর কারণ বলা যেতে পারে যে, সাবেক সচিব মো. আনিসুজ্জামানের প্রতিবেদনের কিছু অংশ শুধু প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তের পুরো বিষয়টি প্রকাশ পায়নি। ফলে আগে থেকেই যে নানান প্রশ্ন উঠেছে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক হয়েছে, তার একটা প্রভাব রয়েই গেছে। ফলে সন্দেহ বা প্রশ্ন রয়েই গেছে। -এমজমিন
২৬ ফেব্রুয়ারি,২০১৬/ এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে