শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫, ০৩:৪৩:২৪

ঘরে চাউল নাই, ছেলে-মেয়ে কান্দে ভাতের জন্য, আমাগো মতো গরিবের কি ঈদ আছে?

ঘরে চাউল নাই, ছেলে-মেয়ে কান্দে ভাতের জন্য, আমাগো মতো গরিবের কি ঈদ আছে?

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ‘ঘরে চাউল নাই। গুরাগারা (ছেলে-মেয়ে) কান্দে ভাতের জন্য। অফিসাররা আয় কিস্তি নেতে কিন্তু দিতে পারি না। বেডায় (স্বামী) দিমু কইয়া যায়, কিন্তু দিতে পরে না। দেবে কেমনে? এখন তো সে সাগরে যায় না। আমাগো মতো গরিবের কি আর ঈদ আছে? ছেলে মেয়ে কারও জন্য কিছুই কিনতে পারি নাই, নিজেগোতা তো বাদ। আল্লাহ যদি ঈদ করায় তাইলে করমু নাইলে না।’

চাপা কষ্ট নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী এলাকার সরকারি আবাসনের বাসিন্দা জেলে মো. ফোরকানে স্ত্রী চম্পা বেগম।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ফোরকান সাগরে মাছ ধরেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সরকারি আবাসনের একটি ঘরে থাকলেও পরিবারের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নতিই করতে পারেননি তিনি। 

সাগর থেকে মাছ শিকার করে মাছ বিক্রির ভাগের টাকায় চলে তাদের সংসার। বছরে বিভিন্ন সময়ে সাগর-নদীতে সরকারি নিষেধাজ্ঞাসহ অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম মাছ পাওয়ায় বছর জুড়ে বেশিরভাগ জেলেদেরই চলতে হয় ঋণ ও ধারের টাকায়। আর এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পরিবার নিয়ে এক প্রকার খেয়ে না খেয়ে জীবন চলে তাদের। ঈদের সময় যেখানে ভালো মন্দ খাবার যোগাতেই হিমশিম খেতে হয় অনেক জেলেকে, সেখানে স্ত্রী-সন্তানকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। 

জেলে ফোরকান বলেন, আমি সাগরে মাছ ধরেই সংসার পরিচালনা করি। তবে জলদস্যুর আতঙ্কে গত একমাস ধরে মাছ ধরতে সাগরে যাই না। বর্তমানে বেকার, সরকারিভাবে যে সহযোগিতা পাই তাতে আমাদের তেমন কিছুই হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলদস্যু, মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞাসহ সাগরে মাছ কম পাওয়া সব মিলিয়ে আমাদের দুরবস্থা লেগেই থাকে। ঈদে ছেলে-মেয়েরা কান্না করলেও চাইলেই তাদের নতুন পোশাক কিনে দিতে পারি না। কীভাবে কি করব আমরা তা বুঝতে পারি না। 

ফোরকানের মেয়ে ফারজানা বলেন, আমার বাবা মাছ ধরতে গিয়ে এবার তেমন মাছ পায়নি। এ ছাড়াও সাগরে ডাকাত আতঙ্কে বাড়ি চলে এসেছে। যদি বেশি মাছ ধরতে পারতো তাহলে আমাদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিত। এখন বাবার টাকা নাই ঈদও হবে না। আমি বাবার কষ্ট বুঝি, কিন্তু আমার ছোট ভাইরা তো আর তা বোঝে না। ওরা তো বাবার কাছে বিভিন্ন আবদার করে কান্না করে।

বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী এলাকার এ আবাসনটিতে শুধু ফোরকান নয়, আরও প্রায় ১৫ থেকে ২০টি পরিবার বসবাস করছেন। এদের সবারই প্রায় একই অবস্থা। অনেকের ঘরেই নেই ঈদের আয়োজন। 

তবে এসব জেলেদের মধ্যে নিবন্ধিত জেলেদের বিভিন্ন সময়ে সরকারি বরাদ্দের চাল বিতরণ করে মৎস্য বিভাগ। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের তুলনায় বরাদ্দকৃত এ সহযোগিতা অতি সামান্য বলেও অভিযোগ রয়েছে এখানকার অনেক জেলেদের। এ ছাড়াও জেলেদের প্রয়োজন মেটাতে চালের পাশাপাশি সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতার দাবিও জনিয়েছেন জেলেরা।

সম্প্রতি সময়ে সাগরে বেড়েছে জলদস্যুদের আক্রমণের খবর। সবশেষ মাছ শিকার করতে সাগরে গিয়ে ট্রলারে জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়েছেন বরগুনার বেশ কয়েকজন জেলে। এসময় তাদের ট্রলারে থাকা মাছ ও বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে জলদস্যুরা। এদের মধ্যে হামলার শিকার হয়ে ভয়ে পুনরায় সাগরে না গিয়ে পরিবারের সঙ্গে বেকার সময় পার করছেন অনেক জেলে।

সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে জলদস্যুদের হামলার শিকার পোটকাখালী আবাসনের বাসিন্দা কালাম হাওলাদার নামে এক জেলে বলেন, আমরা মাছ ধরেই সংসার চালাই। মাছ ধরেই খাই। কয়েকদিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আমি ডাকাতের হামলার শিকার হয়েছি। মারধর করে আমাকে কয়েকঘণ্টা বরফের মধ্যে আটকে রেখেছিল তারা। আমার ছয় সদস্যের পরিবারের সব খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। ডাকাতের কবলে পড়ে সব হারিয়ে এখন প্রায় ৪ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এবার আমাদের ঈদ করার মতো কোনো সুযোগ নেই। বাচ্চাদের কিছু কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য নেই। সরকার আমাদের সহযোগিতার জন্য চাল দেয়। তবে সরকার যদি কিছু আর্থিক সহযোগিতা করত তাহলে আমাদের উপকার হতো।

গাজী হারিসুর রহমান নামে এক ট্রলার মালিক বলেন, বর্তমানে সাগরে জলদস্যুদের উপস্থিতি বেড়েছে। তাই অনেক জেলেই ভয়ে সাগরে যেতে চায় না। সামনে ঈদ। তাদের কোনো আয় রোজগারও নেই। এ ছাড়াও জেলেরা ট্রলার নিয়ে সাগরে না যাওয়ায় আমরা মালিকরা দুরবস্থার মধ্যে পড়েছি।

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, ঈদ উপলক্ষ্যে জেলেদের সহযোগিতার সুযোগ আমাদের নেই। তবে জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকতে বরগুনায় ২৬ হাজার ৪৮৯ জেলেকে আমরা ৮০ কেজি করে চাল দিচ্ছি। সর্বমোট ২ হাজার ১১৯ মেট্রিকটন চাল জেলেদের সহায়তার জন্য বিতরণ করা হবে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে