শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০২:২৯:৩৩

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ

উৎপল রায় : আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ ইস্যুতে গৃহদাহ শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে। আগামী  ২২শে মার্চ অনুষ্ঠেয় প্রথম ধাপের ৭৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ‘স্বতন্ত্র’ পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রায় ৪ শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগ- তাদের বঞ্চিত করে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই প্রার্থীদের নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পেছনে কেন্দ্রীয়, স্থানীয় নেতা এবং এমপি, মন্ত্রীদের মদত থাকায় নির্বাচনে জয়লাভের জন্য আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন বিদ্রোহীরা।

ফলে, বিদ্রোহী ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একে অপরের প্রতি ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা। ইতিমধ্যে দল মনোনীত প্রার্থী নিজেদের পছন্দমতো হওয়া না হওয়া নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, অবরোধ, দলীয় মনোনয়ন বিক্রির অভিযোগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিকে ঘর থেকে তুলে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের তৃণমূলের অনেক  নেতাকর্মীর আশঙ্কা-নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে দল মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল, গৃহবিবাদ, সংঘাত ও সংঘর্ষ হতে পারে। যদিও সরকারি দলের শীর্ষ ও দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতাসহ তৃণমূল নেতাদের অনেকেই বিষয়টিকে আমলে নিতে রাজি নন।

শেষ পর্যন্ত সবাই দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে বিশ্বাস তাদের। তারা এ-ও বলছেন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেন বা কেউ তাদের মদত দেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে সারা দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা বাধা-বিপত্তি, হুমকিধমকি সত্ত্বেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী।

আলাপকালে তারা বলেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক, দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে যে যা-ই বলুক, যা-ই করুক নির্বাচনী মাঠ ছাড়তে রাজি নন তারা। বেশ কজন বিদ্রাহী প্রার্থী আলাপকালে দাবি করেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনে স্থানীয়ভাবে নিজ দলের একাংশের সমর্থন রয়েছে বলেই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এ নিয়ে কী হবে তা এখনই ভাবতে রাজি নন তারা।  

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় দল মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা ও দলীয় কোন্দল, বিবাদের দুশ্চিন্তায় সমঝোতার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চেষ্টা করছেন জেলা, উপজেলার শীর্ষ নেতারা।

কিন্তু বিদ্রোহীদের পেছনে একই দলের একাংশের মদত থাকায় বিষয়টি তাদের জন্য যেমন কঠিন হয়ে পড়েছে তেমনি এ নিয়ে দলীয় কোন্দল ও বিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে- এমন আশঙ্কাও করছেন নেতৃবৃন্দ। দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার এমএ সালাম দলীয় মনোনয়ন লাভের পরই এই ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মফিজুল ইসলাম।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠানোর পরও আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন। যে কারণে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। তিনি আরও বলেন, জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের একাংশ ও এলাকাবাসীর কথায় আমি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো এবং ইনশাল্লাহ জয়লাভ করবো। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জয়নুল আবেদীন জানান, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে দলীয় ফোরামে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আমিনুর রশিদ মিল্টন। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় নেতাদের প্রভাবে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের জোরালো মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. দেলোয়ার হোসেন। জানা গেছে, আমিনুর রশিদ মিল্টনকে মনোনয়ন দেয়ার প্রতিবাদে বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন তালুকদার মো. দেলোয়ার হোসেন। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে উপজেলার আরও ৫ জন শীর্ষ নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

জানতে চাইলে তালুকদার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এলাকায় একজন পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ ও আমার বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও অন্যজনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তাই প্রতিবাদে আমিসহ আরও ৪ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি। তবে, আমি বিদ্রোহী নই, স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছি। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকবো।   

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার সাতটি উপজেলার ৭৭টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতা ও সর্মথক প্রায় শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র পরিচয়ে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, জেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। নিজেদের প্রভাব বিস্তার বজায় রাখার আশায় যে কোনো মূল্যে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিজয়ী করতে চান স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে কেন্দ্রের নির্দেশে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন নেতাকর্মীদের একাংশ। মনোনয়ন নিয়ে ইতিমধ্যে জেলার আশাশুনিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে দল মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে ইউপি নির্বাচনে দল মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন জেলা-উপজেলার বেশির ভাগ নেতাকর্মী। ফলে ইউপি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই বিবাদ ও সংঘাতের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের আশঙ্কা নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে এ বিবাদ বিসম্বাদ আরও বাড়বে। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আশাশুনির ঘটনা আমাদের বিব্রত করেছে। নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে ইউপি নির্বাচন নিয়ে স্থানীয়ভাবে গ্রুপিংয়ের বিষয়টি শুনেছি। বড় দল হলে যা হয় আর কি।

তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বিদ্রোহীদের অনুরোধের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছি। আশা করি শেষ মুহূর্তে অনেকেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন। আর প্রার্থিতা নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা হয়তো ঘটতে পারে। তবে, তা মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে মনে হয় না।

বরিশাল বিভাগের উপকূলবর্তী একটি জেলার সভাপতি নাম না প্রকাশ করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আমাদের জেলায় কিছু নেতার মধ্যে ইতিমধ্যে বিবাদ ও কোন্দল শুরু হয়ে গেছে।

দল মনোনীত প্রার্থীর  বিরুদ্ধে জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ দলীয় পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানরাও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের মদত দিচ্ছেন। নিজেদের দল ভারি করার জন্য এবং নির্বাচনে তাদের জিতিয়ে আনার জন্য নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। এতে করে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের আশঙ্কা করছি আমরা। তিনি আরও বলেন, এখন যে অবস্থা চলছে তাতে প্রতীক বরাদ্দের পর নিজেদের মধ্যে বিবাদ, সংঘাত ও সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।

আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ও কেন্দ্রীয় নেতা ড. আবদুর রাজ্জাক মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলে প্রার্থিতা নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, আমরা চেষ্টা করছি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেন কেউ না যায়। আর শেষ পর্যন্ত কেউ যদি দলের সিদ্ধান্ত না মানেন কিংবা তাদের কেউ মদত দেন তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি প্রার্থিতা নিয়ে তৃণমূলে কোনো ধরনের সংঘাত বা বিবাদ হবে না।  -এম.জমিন

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে