এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : দেশজুড়ে একটি গভীর সংকটে পড়েছে প্রান্তিক ডিম ও মুরগির খামারিরা। পোলট্রি শিল্পে দীর্ঘদিনের অবহেলা, করপোরেট দখলদারিত্ব এবং ন্যায্য দামের অভাব আজ এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে। ডিম-মুরগির খামার বর্তমানে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে ক্ষুদ্র খামারিরা চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ডিম-মুরগির খামার বন্ধের পেছনে বাস্তব কারণ
ডিম-মুরগির খামার বন্ধের সিদ্ধান্ত এসেছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) থেকে। সংগঠনটি বলছে, গত দুই মাসে প্রান্তিক খামারিরা প্রায় ১,২৬০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছেন। এই লোকসানের মূল কারণ—করপোরেট কোম্পানির অযাচিত প্রভাব, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, ঈদের আগেও তারা লাভ করতে পারেননি। উল্টো এক দিনের বাচ্চা উৎপাদন করতে গিয়ে যেখানে তাদের খরচ হয়েছে ২৮-৩০ টাকা, সেখানে সেই একই বাচ্চা করপোরেট কোম্পানিগুলো ৭০-৮০ টাকায় বাজারজাত করেছে।
পোলট্রি খাতের খাদ্য, ওষুধ ও বাচ্চার পাশাপাশি ডিম ও মুরগির বাজারও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে খামারিদের চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনে বাধ্য করতে চাইছে, যা প্রান্তিকদের স্বাধীনতা হরণ করছে।
বিপিএর দাবিসমূহ ও খামারিদের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন তাদের বিবৃতিতে ১০ দফা দাবি পেশ করেছে। এসব দাবি বাস্তবায়িত হলে খামারিদের অবস্থা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
জাতীয় মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা এবং নির্ধারণ কমিটি গঠন
চুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন
পোলট্রি বাজার রেগুলেটরি অথরিটি গঠন
ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ
প্রান্তিক খামারিদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান
করপোরেট কোম্পানিগুলোকে কেবল কাঁচামাল উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রাখা
ডিম ও মুরগির কেজি ভিত্তিক বিক্রির নীতিমালা প্রণয়ন
রপ্তানির সুযোগ বাড়ানো
পূর্ণাঙ্গ পোলট্রি উন্নয়ন বোর্ড গঠন
এই দাবিগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া প্রান্তিক খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পোলট্রি খাতের সংকট শুধুমাত্র একটি খাতের সমস্যা নয়, বরং এটি খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
পোলট্রি খাতের অর্থনৈতিক অবদান ও প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোলট্রি খাতের অবদান অপরিসীম। এই খাতের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামের দরিদ্র কৃষক থেকে শুরু করে নগরের উদ্যোক্তা—পোলট্রি খাত সবার জন্যই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।
কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে, তখন পুরো অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি হস্তক্ষেপ দরকার।
আন্তর্জাতিকভাবে Wikipedia অনুযায়ী, পোলট্রি ফার্মিং বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান খাদ্য উৎস। অথচ বাংলাদেশে এই খাত আজ সংকটে নিমজ্জিত।
করপোরেট বনাম প্রান্তিক: সংকটের মূল দ্বন্দ্ব
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব হলো করপোরেট কোম্পানি ও প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে। করপোরেট কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও পুঁজি ব্যবহার করে বাজার দখলের চেষ্টায় রয়েছে। তাদের এই প্রচেষ্টায় প্রান্তিক খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাজারে তারা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ায়, সংকট তৈরি করে, এবং উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তোলে। প্রান্তিক খামারিরা সেই চাপ নিতে না পেরে এক এক করে খামার বন্ধ করছেন। এটা শুধুমাত্র একটি শিল্পের মৃত্যু নয়, বরং একটি জনশ্রেণির জীবনের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
সরকারের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ করণীয়
সরকারের ভূমিকা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ঘুম ভাঙাতে হবে। বাজারে স্বচ্ছতা আনতে হলে জরুরি ভিত্তিতে পোলট্রি খাত রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করতে হবে।
চুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনায় কঠোর আইন প্রণয়ন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর সীমারেখা নির্ধারণ এবং প্রান্তিক খামারিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এসব না হলে “টাকা নিয়ে বাজারে গিয়েও” ডিম বা মুরগি না পাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
চুক্তিভিত্তিক খামার বনাম স্বাধীন খামার
চুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা এক প্রকার আধুনিক দাসত্বে পরিণত হয়েছে। করপোরেট কোম্পানিগুলো উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে, দাম নির্ধারণ করে এবং লাভের বড় অংশ নিজেদের করে নেয়। খামারিরা তখন তাদের শ্রম ও পুঁজি দিয়ে কেবল ক্ষতিই করছেন।
স্বাধীন খামারিরা যদিও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে খামার চালান, তবু তারা প্রতিনিয়ত করপোরেট চাপে ভুগছেন। এই পরিস্থিতিতে সরকার ও সমাজকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
FAQ: ডিম-মুরগির খামার সংকট সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্ন
১. কেন ডিম-মুরগির খামার বন্ধের ঘোষণা এসেছে?
প্রান্তিক খামারিরা ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ডিম-মুরগির খামার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। মূলত করপোরেট কোম্পানির দখলদারিত্ব ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এই সংকটের পেছনে মূল কারণ।
২. করপোরেট কোম্পানিগুলো কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে?
তারা খাদ্য, ওষুধ, বাচ্চা এবং উৎপাদিত পণ্য—সব কিছুতেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে প্রান্তিক খামারিরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।
৩. সরকারের করণীয় কী?
সরকারকে তদারকি সংস্থা গঠন, চুক্তিভিত্তিক খামার নিষিদ্ধকরণ এবং ক্ষুদ্র খামারিদের সহযোগিতা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. পোলট্রি খাতের ওপর এই সংকটের প্রভাব কী হতে পারে?
খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এবং দামে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। প্রান্তিক খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাজারে ডিম ও মুরগির সংকট আরও প্রকট হবে।
৫. বিপিএর ১০ দফা দাবির গুরুত্ব কী?
এই দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলে বাজারে ন্যায্যতা ফিরে আসবে এবং প্রান্তিক খামারিরা টিকে থাকার সুযোগ পাবেন। এটি একটি টেকসই পোলট্রি খাত গঠনে সহায়ক হবে।
৬. এই পরিস্থিতিতে খামারিদের কী করণীয়?
খামারিদের সংগঠিত হওয়া, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে নীতিমালা তৈরিতে অংশ নেওয়া উচিত।