বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫, ০২:৪৩:০৯

তারেক রহমানের নামেও অনেকে অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দিয়েছে, এটাও আমরা পছন্দ করি না: জামায়াত

 তারেক রহমানের নামেও অনেকে অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দিয়েছে, এটাও আমরা পছন্দ করি না: জামায়াত

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জামায়াতে ইসলামী ঘটনাটিকে ‘রাজনৈতিক রূপ’ দিয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। এতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ দলটি। বিএনপি মনে করছে, মূলত আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে জামায়াত নেতারা পরিকল্পিতভাবে নানান মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে নেমেছেন। 

দলটির নেতারা বলছেন, একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ৫ আগস্টের পর যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের ভিত্তিতে সামনে এগোনো দরকার, সেখানে ইসলামী দু-একটি দল রাজনীতিতে বিভেদ তৈরিতে কাজ করছে। 

এটি শুভ লক্ষণ নয়। তাই জামায়াতের সঙ্গে এবার ‘নির্বাচনী জোট’ গঠনের পরিকল্পনা না থাকলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য অটুট রাখতে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে দীর্ঘদিনের পুরোনো এই মিত্রের কাছ থেকে ‘রাজনৈতিক দলসুলভ’ আচরণ প্রত্যাশা করে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, দেশ যখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন দু-একটি দল নানান কথা বলছে। নির্বাচন যাতে না হতে পারে, সেজন্য মিটফোর্ডের ঘটনা কেন্দ্র করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। কিন্তু লাভ হবে না, দেশবাসী সজাগ রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে যে ঐক্যের মাধ্যমে হাসিনাকে উৎখাত করা হয়েছিল, সেই দলের বদনাম করে, তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে সেই ঐক্যকে যদি কেউ বিনষ্ট করে, তাহলে আন্দোলনে তো সেই দলের অবদান কোনো মূল্য বহন করে না। অনৈক্য সৃষ্টি করার অর্থ হলো যে, ফ্যাসিবাদ যারা ছিল, তাদের আবার ওয়েলকাম করা।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ২৪ বছরের মিত্রতা। দীর্ঘ এই সময়ে সম্পর্কে উত্থান-পতন হলেও জোট ভাঙেনি। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠিত হয়। এ জোটের প্রধান দুটি দল ছিল বিএনপি ও জামায়াত। 

২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। এরপর আবার বিরোধী দলে যায়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ করে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি, যা পরবর্তী সময়ে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। 

তবে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর অনানুষ্ঠানিকভাবে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেয় বিএনপি। পরবর্তী সময়ে জোটের দলগুলো বিভক্ত হয়ে ১২ দলীয় জোট এবং ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ গঠিত হয়। তবে জামায়াত কোনো জোটে ছিল না। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন আরম্ভ হলে শুরুতে দু-একটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিল জামায়াত। তবে পরে দলটি নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এককভাবে আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিল। এমনকি বিএনপির সঙ্গে তখন জামায়াতও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল।

এরপর গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করে। দুই দলেরই এখন লক্ষ্য আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করা। এমন অবস্থায় নানা ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে প্রায়ই টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। জামায়াত জাতীয় এর আগে স্থানীয় নির্বাচন এবং পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন চাইলেও এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। দলটি আগে জাতীয় নির্বাচন এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেই জাতীয় নির্বাচন চায়। এমন টানাপোড়েনের মধ্যে সর্বশেষ মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে। বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল আরেক দলকে ঘায়েলে টার্গেট করে নানা ধরনের ক্যাম্পেইনে লিপ্ত হয়।

বিএনপি বলছে, মিটফোর্ডে নিহত ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ যুবদলের কর্মী। আর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এখানে চাঁদাবাজির কোনো বিষয় নেই। তারপরও দলীয় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন তারা। হত্যাকাণ্ডের স্পটে সরাসরি দেখা না গেলেও ঘটনায় অভিযুক্ত সন্দেহে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের পাঁচজনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপি এমন অবস্থান নেওয়া সত্ত্বেও ঘটনাটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনার দায় তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে। এমনকি এ ঘটনা ঘিরে তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। তা ছাড়া বিএনপিকে ইঙ্গিত করে জামায়াতের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, গত জুলাই-আগস্টে অসংখ্য জীবন এবং নানা ত্যাগের বিনিময়ে নতুন যে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছিল, একটি দলের বিশৃঙ্খলা, হত্যা-সন্ত্রাস, খুন-ধর্ষণের কারণে আজ তা কলঙ্কিত হতে চলেছে। দীর্ঘদিনের পুরোনো মিত্রের এমন আচরণে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছে বিএনপি, যে কারণে তারাও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

গত সোমবার রাজধানীতে এক সমাবেশে জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, গায়ের জোরে কথা বলেন, অথচ নিজের পায়ে জোর নেই। এরশাদের সময়ে এরশাদের কাঁধে ভর করেন, আওয়ামী লীগের সময়ে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করেন, বিএনপির সময়ে বিএনপির কাঁধে ভর করেন, আবার লম্বা লম্বা কথা বলেন। এখন বিএনপি ওদের একমাত্র মাথা ব্যথা। বিএনপিকে যদি শেষ করে দেওয়া যায়, তাহলে উনারা রাজত্ব করতে পারবেন। তারা তারেক রহমানকে সহ্য করতে পারছেন না। তবে কোনো লাভ নেই, তারেক রহমান তার সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত মঙ্গলবার কুড়িগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বলেন, জিয়াউর রহমানের অনুকম্পায় দুয়েকটি ইসলামী দল রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে। এখন আপনারা টার্গেট করেছেন তারেক রহমান ও বিএনপিকে। বুক-পিঠ বলে আপনাদের কিছু নেই। তারেক রহমানকে নিয়ে অপপ্রচারে নামবেন না, তাহলে আপনাদের নিজেদেরই ওপর অনেক কিছু নেমে আসবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী কখনো এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। একেক সময় একেক জায়গায় তাদের ভালো লাগে এবং এই ভালো লাগার ওপর ভিত্তি করে তারা আবার স্থান পরিবর্তন করে। এক সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে খাতির, এক সময় জাতীয় পার্টির সঙ্গে খাতির, আবার এক সময় বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন, আবার বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন। এই যে দলীয় অবস্থান পরিবর্তন, এটা জামায়াতের দীর্ঘদিনের একটা ঐতিহ্য। তারা হয়তো সেই ঐতিহ্যই ধারণ করছে। এরই একটি নমুনা তারা সম্প্রতি আবারও দেখাল।

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের ভূমিকা নিয়েও বিএনপি অসন্তুষ্ট। দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে, চরমোনাই পীরের একটা সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এখন বিএনপিবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে সমাবেশ করেছে। এদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান বিএনপি।

চরমোনাই পীরকে ইঙ্গিত করে সম্প্রতি বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেন, ওই লোকটি এবং তার দল (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) স্লোগান দিচ্ছে-বলছে, আওয়ামী লীগ গেছে যেই পথে, বিএনপি যাবে সেই পথে। আরে বেটা, এত সহজ নাকি এটা। এই বাংলাদেশ আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। এই লোকটি এবং তার দলবল বিএনপিকে এখন সহ্য করতে পারছে না; কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঠিকই সহ্য করতেন। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যখন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের ওপরে হামলা করা হয়েছিল, এই চরমোনাই পীর সাহেব তখন কোথায় ছিলেন? উনি কি মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন? দাঁড়াননি। কে দাঁড়িয়েছে? বিএনপি দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনীতিতে অনেক সময় অন্য কোনো সুযোগ নিয়ে পরাশক্তির ইঙ্গিতে কোথাও কিছু ঢুকে পড়তে চায়, স্পেস চায়। এখানে তারা তাদের একটা গ্রাউন্ড তৈরি করার জন্য যে অনেক খেলা খেলছে না, তা-ও তো আমরা বলতে পারি না। বহু বিদেশি সংস্থা তো এখানে ওয়ার্ক করছে, এটা বিএনপিকেও উপলব্ধি করতে হবে, জামায়াতকেও উপলব্ধি করতে হবে। কিছু হলেই আমরা বিএনপির দিকে ছুড়ে দেব, বিএনপি আমাদের দিকে ছুড়ে দেবে—তাহলে তো রাজনৈতিক সৌজন্যতা, সহমর্মিতা, বিনয়, সংযম, সহমত—এগুলো থাকে না।

তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামেও অনেকে অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দিয়েছে, এটাও আমরা পছন্দ করি না। যারা এটা করেছে, তারা কেউই জামায়াত-শিবিরের লোক না। জামায়াত-শিবিরের মিছিল থেকে এমন স্লোগান আপনারা কোথাও পাবেন না।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় চাঁদাবাজির বিষয়ে আমরা তো কারও নাম বলিনি যে, আব্দুর রহিম বা আব্দুল করিম চাঁদাবাজি করেছে। বিএনপি তো এই অপরাধে তাদের সংগঠনের কয়েকজনকে বহিষ্কারও করেছে। বহিষ্কার করায় কী প্রমাণ হলো, আপনার দলেরই তো লোক। জামায়াতে ইসলামী প্রতিহিংসা বা নোংরা রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়।-কালবেলা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে