এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গত ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি পালন করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
মাসব্যাপী এ কর্মসূচির অংশ হিসাবে গোপালগঞ্জে বুধবার তাদের সমাবেশ ছিল। এ কর্মসূচিকে ঘিরে শুরু থেকেই চলে নানা অপপ্রচার। বিশেষ করে এনসিপির নেতাকর্মীরা দলবল নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কবর ভাঙচুর করবেন-এমন একটি অপপ্রচার মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা এনসিপির সমাবেশে হামলার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি দিল্লি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দিল্লি থেকে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন।
তাছাড়া এনসিপির বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিতে বেশকিছু অডিও বার্তাও পাঠান। হাসিনার পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাবেশ শুরু আগে মঞ্চ ভাঙচুর এবং নেতারা বক্তব্য শেষ করে যাওয়ার পথে তাদের গাড়িবহর অবরুদ্ধ করে ফেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কী কথা বলেছেন তার অডিও যুগান্তরের হাতে আসে। টার্গেট ছিল এনসিপিকে ঢুকতে দেওয়া হলেও দলের নেতাকর্মীদের জীবিত বের হতে দেওয়া হবে না।
যুগান্তরের হাতে থাকা এমন একটি অডিও বার্তায় শোনা যায়, শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালকে বলেন, ‘ওরা (এনসিপি) নাকি গোপালগঞ্জে যাচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ায় আমার বাবার কবর ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এবার টুঙ্গিপাড়ায় হামলা চালাবে। তোমরা বসে আছ কেন? যে যেভাবে পার প্রতিহত কর। গোপালগঞ্জে কোনোভাবেই যাতে ওরা ঢুকতে না পারে। কোনো ধরনের কর্মসূচি যাতে করতে না পারে। মনে রাখবা, গোপালগঞ্জের মাটি থেকে ওদের কেউ যাতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।’
আরেকটি অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও শহরের বেদ গ্রামের বাসিন্দা নিউটন মোল্লাকে বলেন, ‘তোমরা ওখানে (গোপালগঞ্জে) বসে কী কর। ওরা (এনসিপি) বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করছে। পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে লোকজন একত্রিত করে গোপালগঞ্জে ঢুকবে। এরপর টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। যেভাবে পার ওদের প্রতিহত করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ায় যাতে কোনোভাবেই ওরা ঢুকতে না পারে। আর যদি টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকেই পড়ে, তাহলে একজনও যাতে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরদিন বুধবার গোপালগঞ্জ পৌর পার্ক মাঠে এনসিপির কর্মসূচির দিন সকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই স্থানীয় চর দুর্গাপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এলাকায় জানান দেয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহরের মোহাম্মদপাড়ার বাসিন্দা এই আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বেই পরে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে কয়েক দফা গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।
একইভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা কারাগারে হামলা চালানো হয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিউটন মোল্লার প্রধান টার্গেট ছিল কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে সেখানে আটক থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহাবুদ্দিন আজমসহ দলের নেতাকর্মীদের বের করে আনা। যদিও পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে তার এ অপচেষ্টা সফল হয়নি। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাসুদ রানার নেতৃত্বে ওইদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতে হামলা চালানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগই নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেন।
গোপালগঞ্জের মাটিতে এনসিপি যাতে কোনোভাবেই তাদের কর্মসূচি পালন করতে না পারে, সেজন্য প্রত্যেককে তিনি নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার নির্দেশের পর এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করাসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে গোপালগঞ্জে থাকা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চতুর্দিক থেকে একযোগে হামলা চালান।
এ সময় নেতাকর্মীদের সমন্বয় করেন কলকাতায় থাকা শেখ হাসিনার ফুপাতভাই গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লন্ডনে বসে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুর রহমান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এবং গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজল।
তাদের বাইরে গোপালগঞ্জসহ আশপাশের জেলা-উপজেলায় আত্মগোপনে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। কলকাতায় আত্মগোপনে থেকেই ফেসবুকে লাইভে এসে তিনি মাঠের কর্মীদের এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা করতে নির্দেশনা দেন।
স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের এ কাজে সংগঠিত করেন কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আলম কাজলের স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ইয়াসমিন আলম। যদিও বিষয়টি জানার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আটক করে। ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি পালন করে দলটি।
মাসব্যাপী এ কর্মসূচির অংশ হিসাবে বুধবার ছিল গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন। আগের দিন মঙ্গলবার দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ কর্মসূচিকে ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। গোপালগঞ্জে কর্মসূচি পালন শেষে এনসিপির নেতাকর্মীদের শরীয়তপুরের জাজিরায় আরেকটি কর্মসূচি পালনের কথা ছিল।সূত্র: যুগান্তর