বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫, ০২:৫০:১২

বাঁচতে চামড়া ঝলসানো শরীরে দৌঁড়ানো ছেলেটিই হচ্ছেন রোহান

বাঁচতে চামড়া ঝলসানো শরীরে দৌঁড়ানো ছেলেটিই হচ্ছেন রোহান

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে এক শিক্ষার্থী স্কুল মাঠে দৌড়াচ্ছিল। তখন তার শরীরের জামা কাপড় সব পুড়ে গেছে। শরীরের পা থেকে গলা পর্যন্ত বেশিরভাগ অংশের চামড়া ঝলসানো অবস্থায় দৌড় দেয়া শিশুটির নাম রবিউল হাসান নাবিল। পরিবারের কাছে রোহান নামে পরিচিত। 

সে স্কুলের ইংরেজি সংস্করণের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ১৪ বছর বয়সী রোহানের পরিচয় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত জানা যায়নি। কিন্তু তার জ্বলন্ত ছবি পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেলেটির ভিডিও দেখে মানুষ কেঁদেছিল। অনেকেই ছেলেটির বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনায় হাত তুলেছিল।

চামড়া ঝলসানো শরীরেমঙ্গলবার বিকালে এই প্রতিবেদক ঘটনাস্থল সরেজমিন করে মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন আসেন। মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া একটি মেট্রো ট্রেনের তিন নম্বর কোচের সীটে বসেন। ঠিক ডান পাশে ৫৫ বছর বয়সের এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছিলেন। মাঝে মধ্যেই হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। মেট্রোরেলের ওই কোচের সকল যাত্রীর দৃষ্টি পড়ে যায় ওই ব্যক্তির ওপর। মোবাইল ফোনে কথা বলা শেষে তার কাছে কেন কাঁদছেন, জানতে চাইলে বলেন, আমার ছেলেটা বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়েছে। তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।’

একটু পরেই জোরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘ভাইরে যে ছেলেটি স্কুলের মাঠের মধ্যে দিয়ে জ্বলন্ত দেহ নিয়ে দৌড়াচ্ছিল, বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল, ওটা আমার ছেলে।’ বলতে বলতে তার কন্ঠ কাঁপছিল। তার কান্না আরও জোরে বাড়তে থাকলে, পুরো কোচে ছড়িয়ে পড়ে। তার দুঃখের বোঝা কাছাকাছি বসে থাকা সকলেই অনুভব করেছিল।

রোহানের বাবার নাম নিজাম উদ্দিন, পেশায় পাইলিং ঠিকাদার। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে তার বাড়ি। পরিবারটি উত্তরার সেক্টর ১২-এর ১৫ নম্বর রোডের ৫০ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকে। রোহান এখন বার্ন ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন, ৫০ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে তার শরীর।

‘আমার ছেলের জন্য দোয়া করেন,’ তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে থাকেন, ‘রোহান তার পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছিল। তার পরনে কোনও পোশাক ছিল না। এক পর্যায়ে, কিছু লোক তাকে ওই অবস্থায় রিকশায় করে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন পর্যন্ত কী ঘটেছিল তা আমরা জানতাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছোট ছেলেটি সাহসী। ভিডিওটি দেখে লোকেরা আতঙ্কিত হলেও, তার হৃদয় ছিল শক্তিশালী। হাসপাতালে, সে নিজেই তার মায়ের মোবাইল নম্বর দিয়েছিল। এভাবেই আমরা জানতে পারি সে কোথায় আছে।’

একই কোচে ছিলেন রোহানের চাচা মোতাছের হোসেন, যিনি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে তাদের বাসা থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। তারা রোহানের বাসা থেকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যাচ্ছিলেন।

নিজাম যখন কথা বলছিলেন, মোতাছের চুপচাপ তার চোখের জল মুছে দিচ্ছিলেন। নিজাম তার পরিবারের কথা আরও জানালেন। তার বড় ছেলে শিহাব এবং একমাত্র মেয়ে নাসরিন সুলতানা নুপুরও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করেছে।

তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে, আমি আমার বাচ্চাদের এই স্কুলে পাঠিয়ে আসছি। সোমবার আমি রোহানকে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। এখন সে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। ওর মা নাসিমা বেগম তার পাশে থেকে সন্তানের যত্ন নিচ্ছেন।

চলমান মেট্রোর তিন নম্বর কোচে ধীরে ধীরে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল। যাত্রীরা ভিডিওটি নিয়ে একে অপরের সাথে ফিসফিস করে বলতে শুরু করেন। একটি শিশুকে আগুনে দৌড়াতে দেখার ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু লোক সেই মুহূর্তটি স্মরণ করে হাঁপিয়ে উঠছিল। অন্যরা অবিশ্বাস্যভাবে মাথা নাড়ল। তবুও দুঃখের মধ্যে ঐক্য ছিল। এক পিতার দুঃখের কথায় কোচের সবার মধ্যে আলোচনা চলছে। দেড় মিনিট, কখনও দুই মিনিট পরপর একটি স্টেশনে থামছে। এভাবে কখন যে শাহবাগ স্টেশন চলে এলো, এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে, ‘শাহবাগ স্টেশন, দরজাগুলো বাম দিক থেকে খুলবে।’ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে হাতটি মিলিয়ে দেশবাসীর কাছে ছেলের জন্য দোয়া চাইলেন।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে