এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বিভাগ। নিঃশব্দ এই করিডোরে শুধু শোনা যায় জীবনের জন্য লড়াই করা নিঃশ্বাস, কখনো বা স্বজনদের চাপা কান্নার শব্দ।
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যেসব শিশু-কিশোর আগুনে ঝলসে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কেউ কেউ সেই লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে প্রতিদিন।
দিন দুই আগেও আইসিইউর সামনে অপেক্ষারত স্বজনদের মুখে ছিল উদ্বেগ, চোখে ছিল আশার দীপ্তি—তাদের প্রিয়জন এখনো বেঁচে আছে, এখনো লড়ছে। সময়ের সঙ্গে সেই ভিড় এখন ক্রমেই কমছে। আশার জায়গায় ভর করছে শোক, অপেক্ষার জায়গা নিচ্ছে মৃত্যুর সংবাদ।
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র বলছে, দুদিন ধরে প্রতিদিনই এক বা একাধিক দগ্ধ শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার সকালেও এক ঘণ্টার ব্যবধানে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছে আরও দুটি নাম।
সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিক্ষার্থী জারিফ। এরপর মাসুমা নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়। সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ নিয়ে এ ঘটনায় পাঁচ দিনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে অনেকেই সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
নিহত মাসুমার স্বামী মো. সেলিম জানিয়েছেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন মাসুমা। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। তুরাগ থানার নয়ানগর শুক্রভাঙ্গা এলাকায় থাকতেন তারা।
জারিফের বাবা মো. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, জারিফ ফারহান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর রোডের বাসায় থাকেন তারা। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়।
শনিবার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েকদিনের তুলনায় সেখানে স্বজনের ভিড় অনেকটাই কম। করিডোরে দিনভর কান্না আর উৎকণ্ঠায় ক্লান্ত স্বজনরা ফিরে গেছেন মরদেহ নিয়ে। এখনো চিকিৎসাধীন থাকা রোগীদের স্বজনদের কেউ কেউ চুপচাপ বসে আছেন দেয়ালের পাশে মাথা ঠেকিয়ে, কেউ আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সেখানেই কথা হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তারের (১০) বাবা রহিম মাহমুদের সঙ্গে। শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া মেয়েকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছিলেন এ বাবা নিজেই। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় এখানে।
দুঃস্বপ্নের সেই দিনের কথা স্মরণ করে এ বাবা বলছিলেন, মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য স্কুলের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। যে জায়গায় বিমানটা এসে বিধ্বস্ত হয়েছিল ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও সেখানেই ছিলেন তিনি।
রহিম মাহমুদ বলেন, ঘটনার পর মনে হচ্ছিল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল—এমন একটা পরিস্থিতি। চারদিকে চিৎকার আর হাহাকার। আমার মেয়েটা ঘটনার পর স্কুল থেকে দৌড়ে বের হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তখন অনেকেই তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়, সেজন্য মাথায়ও কিছুটা আঘাত পায়। আমি সেনাবাহিনীর সাহায্যে মেয়েকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসি। এখন অল্প কিছু খেতে পারলেও শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার।
গত কয়েকদিনের পরিবেশ বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, এখানে তো আমাদের সঙ্গে এতদিন অনেকেই ছিল। মাহতাব নামে যে বাচ্চাটা মারা গেল, সেই মাহতাবের বাবা আর আমি কয়েকদিন একসঙ্গেই ফ্লোরে শুয়ে থাকতাম। ছেলেটা বাঁচবে বলে অনেক আশা ছিল; কিন্তু বাঁচেনি। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন মারা যাওয়ায় এ ফ্লোরে সারাক্ষণ থাকা মানুষগুলোও চলে যাচ্ছে আশাভঙ্গ হয়ে।
এদিকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মেহাম্মদ নাসির উদ্দিন। শনিবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
নাসির উদ্দিন জানান, একই সঙ্গে এ ঘটনায় দগ্ধ রাফসি (১২) ও আয়ান খান (১২) নামে দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, এখনো জাতীয় বার্নে ৩৬ রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চারজন। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সিভিআর ক্যাটাগরিতে ৯ জন। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ডে ভর্তি। আগামী এক সপ্তাহে আরও ১০ জনকে পর্যায়ক্রমে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিচালক বলেন, চিকিৎসায় সহায়তা দিতে ভারত থেকে দুই চিকিৎসক ও দুই নার্স, সিঙ্গাপুর থেকে তিন চিকিৎসক ও দুই নার্স এবং চীন থেকে তিন চিকিৎসক ও ছয়জন সাপোর্টিং স্টাফ এসেছেন। তাদেরও এখানকার চিকিৎসকদের সমন্বয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।