পলাশ মাহমুদ: আগামীকাল ১১ আগস্ট বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সব ধরনের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও ড. ইউনূসের পুরোনো শুভাকাঙ্ক্ষী আনোয়ার ইব্রাহিম।
দুই নেতার সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদের হাতছানি দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরে নানা বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তবে এ সফরে মালয়েশিয়ায় বিনা খরচে শ্রমিক পাঠানোর যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করলে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বড় সুফল বয়ে আনতে পারে।
মালয়েশিয়ার বিদেশি শ্রমিকের সর্বোচ্চ অনুমোদিত সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক রয়েছে ২০ লাখের কিছু কম। সে হিসেবে দেশটিতে শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। প্রতি বছর যে পরিমাণ শ্রমিক দেশে ফিরে যায় এবং কর্মসংস্থানের কারণে নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয়, তা মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যায়। ১৪টি দেশ থেকে এসব শ্রমিকের চাহিদা মেটায় মালয়েশিয়া। এই দেশগুলোকে বলা হয়, সোর্স কান্ট্রি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিক পাঠিয়ে এই সোর্স কান্ট্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, সবকিছু ঠিক থাকলে প্রতি বছর দুই লাখ করে আগামী ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে।
তবে বাংলাদেশ থেকে যে প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নেওয়া হয়, তা দুঃখজনকভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র ‘ন্যায্য নিয়োগের সাধারণ নীতি ও কর্মপরিচালনা নির্দেশনা’ (General Principles and Operational Guidelines for Fair Recruitment)-এর একটি মূল নীতি হলো ‘নিয়োগকর্তাই সব ব্যয় বহন করবে’ (Employer Pays Principle)। এই নীতির মূল বক্তব্য হলো, শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে তার সব খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবে। অর্থাৎ, শ্রমিকের পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে ভিসা ফি, মেডিকেল চেকআপ, বিমানের টিকিটসহ সব খরচ নিয়োগকর্তাকে দিতে হবে। শ্রমিকের কাছ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো খরচ আদায় করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিয়োগকর্তার খরচে এরই মধ্যে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে শ্রমিক নিচ্ছে মালয়েশিয়া। এ ছাড়া নেপাল ও ভারতও আংশিক এ সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এসব দেশ থেকে যারা এই সুবিধায় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে, তাদের কোনো খরচ হচ্ছে না। উল্টো নিয়োগকর্তা তাদের সব খরচ দিচ্ছে। ১৪টি সোর্স কান্ট্রির শীর্ষে থাকার পরও দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ এখনো এ সুবিধা পায়নি। এমনকি এ সুবিধা এর আগে সরকারিভাবে দাবিও করা হয়নি। যেহেতু এ দাবিটি যৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সে কারণে এটি আদায় করে নেওয়া কঠিন হবে না। ড. ইউনূসের সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিমের সম্পর্ক বিষয়টি আরও সহজ করে দিতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানকে এ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে মালয়েশিয়া সরকার ইতিবাচক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু শ্রমিক প্রেরণের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ এবং ড. ইউনূসের সঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিমের সুসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আসন্ন সফরে এই দাবি জানানো হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে বিনা খরচে শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে মালয়েশিয়া।
বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক আইন মেনে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে মালয়েশিয়াকে রাজি করাতে পারে, তাহলে প্রবাসগামী শ্রমিকদের আর কোনো মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালারের খপ্পরে পড়তে হবে না। এ ছাড়া বর্তমান নিয়মে প্রতি শ্রমিক গড়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করে। বছরে ২ লাখ করে শ্রমিক গেলে এ হিসাবে শ্রমিকদের বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে, যা আগামী ৬ বছরে হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিনা খরচের পদ্ধতি চালু হলে বিপুল এই অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকরা যাওয়ার আগেই অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হবে বাংলাদেশ। নিয়োগকর্তা যদি শ্রমিকের সব খরচ বহন করে, তাহলে ওই শ্রমিকের পাসপোর্ট ফি, মেডিকেল ফি, বিমানের টিকিটসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রায় দেড় লাখ টাকা প্রদান করবেন যে অর্থ মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসবে। এ বিষয়ে শ্রমিক যাওয়ার আগেই বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে আসবে, যা ৬ বছরে হবে ১৮ হাজার কোটি। অর্থাৎ আগে যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পকেট থেকে বের হয়ে যেত ৬০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে উল্টো বাংলাদেশে ঢুকবে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
মালয়েশিয়ায় বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে। দেশটিতে ন্যূনতম মজুরি ১৭০০ রিঙ্গিত বা প্রায় ৫১ হাজার টাকা। এসব শ্রমিক প্রতি মাসে গড়ে ২৮ হাজার টাকা করে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। এই হিসাবে গত মে মাসে মালয়েশিয়া বৈধপথে থেকে ৪ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। আগামী ছয় বছরে আরও ১২ লাখ শ্রমিক সেখানে গেলে রেমিট্যান্সে মাসে নতুন যুক্ত হবে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা।
দেশের জন্য এই বিরাট সুবিধা আদায়ে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি বাধাগুলো দূর করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এখন ভুগছে গোটা শ্রমবাজার। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে নিজেদের মধ্যে কয়েকটি মামলা করেছে তারা। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মানব পাচার ও অর্থ পাচার মামলা করা হয়। সরকার নিজে যখন মালয়েশিয়ায় মানব ও অর্থ পাচার হয় মর্মে মামলা করেছে তখন বেঁকে বসেছে দেশটি। কারণ, এর ফলে ‘আন্তর্জাতিক মানব পাচার সূচক’ (টিআইপি) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালয়েশিয়া। টিআইপি র্যাঙ্কে মালয়েশিয়া বর্তমান টায়ার-২ ক্যাটাগরিতে রয়েছে।
মালয়েশিয়ায় মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশে তিনটি মামলা হয়েছে, যা নিয়ে কুয়ালালামপুর সরকার বেশ উদ্বিগ্ন। গত এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখে বাংলাদেশকে একটি চিঠিও দিয়েছে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব আজমান মোহাম্মদ ইউসুফ। পররাষ্ট্র সচিবকে দেওয়া চিঠিতে তারা আন্তর্জাতিক মানব পাচার সূচকে মালয়েশিয়ার রেটিং উন্নত করার জন্য বাংলাদেশে হওয়া ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ পর্যালোচনা এবং প্রত্যাহার করার আহ্বান জানায়। বিষয়টি নিয়ে প্রথম খবর প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ। ওই চিঠির পর মানব পাচার মামলায় সিআইডি ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তবে দুদকের অর্থ পাচার মামলার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরেও হওয়া মামলার কোনো সমাধান হয়নি। এসব মামলায় জড়িয়ে আছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ফলে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালয়েশিয়া। সে কারণে তারা সরকারিভাবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এর সমাধান করতে বলছে। এজন্য এসব জটিলতা দ্রুত সমাধান করে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে সম্মান দেখানো বাংলাদেশের জন্য জরুরি, যাতে বিনা খরচে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ হাতছাড়া না হয়।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সে হিসেবে এ সফরই হতে পারে তার সরকারপ্রধান হিসেবে মালয়েশিয়ায় প্রথম ও শেষ সফর। তাই এ সফরটি অসামান্য অর্জনের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হয়ে উঠেছে। যদি ড. ইউনূস এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিনা খরচে শ্রমিক পাঠানোর সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের দরিদ্র, খেটে খাওয়া লাখো প্রবাসীর হৃদয়ে তিনি স্থায়ীভাবে স্থান করে নেবেন—এটা নিঃসন্দেহে প্রত্যাশা করা যায়।
লেখক: অনলাইন সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা ও নির্বাহী পরিচালক, কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)