বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ০৯:৩৮:৪৩

শিক্ষা সংস্কারে ৩০ দফা প্রস্তাবনা দিল ছাত্রশিবির

শিক্ষা সংস্কারে ৩০ দফা প্রস্তাবনা দিল ছাত্রশিবির

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিক, কল্যাণমুখী ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে আয়োজিত ‘শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

শিক্ষা সংস্কারে জরুরি উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রম করে আমরা এখন দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরণে ফ্যাসিবাদী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কল্যাণমুখী এবং সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা বা কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রটিকে বারবার উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা গভীরভাবে হতাশাজনক।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনটি বিশ্বাস করে, একটি আদর্শ জাতি গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ছাত্রশিবিরের মৌলিক ৫ দফা কর্মসূচির অন্যতম অংশ হলো ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্রসমস্যা সমাধান।’

জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০ বছরের দীর্ঘ আজাদীর লড়াইয়ের বিজয় এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এটি শুধু ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিই নয়, বরং জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতির সূচনা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভাষা ও সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন এবং রাজনৈতিক বৈষম্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে, যা ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসকে নতুন দিকে নিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরও ৫৪ বছর পার হয়ে গেলেও এই দেশের মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পায়নি। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধে চরম অবক্ষয়, গণতান্ত্রিক কাঠামোর ধ্বংস এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তুলেছে। একদলীয় শাসন, দমন-পীড়ন, গুম, দুর্নীতি, ভোটাধিকার হরণ এবং অর্থপাচারের সংস্কৃতি দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান নতুন জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।’

ছাত্রশিবির সভাপতি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা পূরণে শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে সমতাভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল। যা নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং কর্মদক্ষতা বিকশিত করবে। শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সব বৈষম্য দূর করে বিনা মূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।’

তিনি জানান, ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত হলেও বাংলাদেশে এই হার ২ শতাংশেরও কম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সিঙ্গাপুর জাতীয় বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ১৭-২০ শতাংশ, ভারত ১৩-১৭ শতাংশ (জাতীয় বাজেটে প্রায় ২.৫%) এবং চীন ১০-১৩ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ১.৮-২ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

ছাত্রশিবিরের ৩০ দফা প্রস্তাবনাগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কমিশন গঠন; জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ; ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা-সমন্বিত আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন; বহুমাত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় (STEM) অগ্রাধিকার প্রদান, ভাষা শিক্ষা সংস্কার; সামরিক ও শারীরিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ; শিক্ষা বাজেট অগ্রাধিকার; শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক স্কুলিং পদক্ষেপ; উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন; স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন প্রণয়ন; নারী শিক্ষার প্রসারে উপর্যুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন নিশ্চিত ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ এবং  মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

এ ছাড়া শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাঙ্গন বাস্তবায়ন; যোগ্য ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ গঠন; গবেষণামুখী উচ্চশিক্ষা; মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সংক্রান্ত; কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি; মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার; শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়ন; শিক্ষক মূল্যায়নের কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন; চাকরিতে সমান সুযোগ ও ন্যায়ভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ; ছাত্ররাজনীতির যথাযথ চর্চা ও নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক আয়োজন করতে; কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস; উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়ন ও সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ।

জাহিদুল ইসলাম আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই ৩০ দফা প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি দূর হবে এবং সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির পথ সুগম হবে, ইনশাআল্লাহ।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে