এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : লন্ডনে পুত্র তারেক রহমান, পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও নাতনি ব্যারিস্টার জাইমা রহমানের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ৩০ মার্চ ছবিটি তারেক রহমান ফেসবুকে পোস্ট করেন।
দীর্ঘ ১৭ বছর সুদূর লন্ডনে থেকেও নিষ্পেষিত, নিপীড়িত বিএনপির হাল শক্ত হাতে ধরে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত বছরের জুলাই-আগস্টে দলটির নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের দিকনির্দেশনায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা শাসনের অবসান ঘটে। এর পর থেকেই তারেক রহমানের অপেক্ষায় আছে দেশ।
যদিও আগে থেকেই তাঁর ফেরার ব্যাপারে বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর ঘিরে আলোচনা ছিল। কিন্তু সঠিক দিনক্ষণ কারো কাছে নেই। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারেক রহমান নিজেই জনগণের মাঝে থাকতে চেয়েছেন, দলকে দেশে থেকেই নেতৃত্ব দিতে চেয়েছেন।
গত ২৩ নভেম্বর রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে। এর মধ্যে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটজনক’। এরই মধ্যে ১০ দিন পার হলেও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশাপাশি দেশবাসীর মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এ অবস্থায় অনেকেই মনে করছেন, মায়ের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুতই তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারেন।
গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন।’
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গত সোমবার চীনা মেডিক্যাল টিম ও গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের মেডিক্যাল টিম দেশে এসেছে। তারা এ দেশের মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে সমন্বয় করে চিকিৎসায় পরামর্শ দিচ্ছে। তারা যদি মনে করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন এবং ট্রাভেলের মতো পরিস্থিতি আছে, তবেই তাঁকে বিদেশে নেওয়া হতে পারে।
যদি খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া হয়, তাহলে তারেক জিয়ার দেশে ফেরা কিছুটা দেরি হতে পারে। আর যদি তিনি দেশেই চিকিৎসা নেন, তাহলে শিগগিরই দেশে ফিরতে পারেন তারেক জিয়া।
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন তারেক রহমান। বৈঠক থেকে বেরিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিগগিরই দেশে আসবেন তারেক রহমান।’
গত সোমবার রাতে খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার পর স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে এসএসএফ সদস্যরা খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেন। এতে অনেকেই মনে করছেন, পরিবারের সদস্য হিসেবে তারেক জিয়া দেশে ফিরলে এই এসএসএফ নিরাপত্তা পাবেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তারেক জিয়া দেশে ফিরলে তাঁর জন্য একই নিরাপত্তার উদ্যোগ নেবে সরকার। ফলে তারেক জিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল তা দূর হবে।
গত ২৫ নভেম্বর নিজের ভেরিভায়েড ফেসবুক পোস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘সংকটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেকোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সবার মতো এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। স্পর্শকাতর এই বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনার অবকাশও সীমিত। রাজনৈতিক বাস্তবতার এই পরিস্থিতি প্রত্যাশিত পর্যায়ে উপনীত হওয়ামাত্রই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমার সুদীর্ঘ উদ্বিগ্ন প্রতিক্ষার অবসান ঘটবে বলেই আমাদের পরিবার আশাবাদী।’
গত অক্টোবরে বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দেশে ফেরা নিয়ে তারেক রহমান জানিয়েছিলেন, ‘রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রোত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত, যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে জনগণের সাথে জনগণের মাঝেই থাকব ইনশাআল্লাহ।’
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে তফসিল হতে পারে। আর নির্বাচন হতে পারে ৮ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। এরই মধ্যে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ২৩৬ আসনে তাদের প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বাকি আসনগুলোতেও প্রার্থী চূড়ান্তের কাজ চলছে। সারা দেশে বইছে নির্বাচনী জোয়ার। এ অবস্থায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। ফলে তারেক জিয়াকে এখন দেশে খুবই দরকার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তারেক জিয়ার দেশে ফেরায় বড় বাধা ছিল নিরাপত্তা ইস্যু। যদি এসএসএফ তাঁকে নিরাপত্তা দেয়, তাহলে কিছুটা হলেও তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। শিগগিরই তফসিল ঘোষণা হবে। এরই মধ্যে আবার দেশনেত্রী বেগম জিয়া গুরুতর অসুস্থ। ফলে সব মিলিয়ে তারেক রহমানের জন্য অপেক্ষা করছে দেশবাসী।
তারেক রহমানের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, ‘বাংলাদেশে কারো কোনো নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবার নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত আছে। একই সঙ্গে বিশেষ নিরাপত্তা যাঁদের জন্য দরকার, তাঁদের জন্যও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তুত আছে।’
জানা যায়, তারেক রহমান দেশে ফিরলে তিনি কোথায় থাকবেন, কিভাবে চলাফেরা করবেন সে বিষয়েও দলের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর গুলশান-২-এর এভিনিউ রোডে একটি বাড়ি প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ছাড়া জাপান থেকে বুলেটপ্রুফ গাড়ি আমদানিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার জন্য এখনো ট্রাভেল পাস চাননি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তারেক রহমান এখনো ট্রাভেল পাস চাননি। তিনি চাইলে ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হবে। তাঁর ঢাকায় ফেরার বিষয়ে সরকারকে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি।
এর আগে গত রবিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কেউ দেশে ফিরতে চান, আর তাঁর যদি পাসপোর্ট না থাকে, তাহলে তাঁর জন্য ট্রাভেল পাস মূলত একবারের জন্য ইস্যু করা হয়। এটা এক দিনের মধ্যেই ইস্যু করা যায়। এটার জন্য সময় লাগে না।’
এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিশেষ করে মেডিক্যাল বোর্ডে যেসব চিকিৎসক আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান।
বিএনপি ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তবে যেহেতু মা বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা হঠাৎই বেড়ে গেছে এবং তিনি বেশ কয়েক দিন ধরে হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন, তাই প্রয়োজন হলে তাঁর দেশে ফেরা এগিয়ে আসতে পারে।
বিএনপি নেতারা আরো বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সার্বক্ষণিক বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখছেন। মায়ের এই অবস্থায় তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। তাই প্রয়োজন হলে যেকোনো সময়ই তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারেন। সে রকম প্রস্তুতিও আছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না এবং কাউকে তিনি জানানওনি।
এদিকে তারেক রহমান হঠাৎ করে দেশে ফিরলে তাঁর ফেরাকে স্মরণীয় করে রাখতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘ দেড় দশক তারেক রহমান যেভাবে দলকে সুসংগঠিত রেখেছেন, নেতাকর্মীসহ দেশের বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানে তাঁর সফল নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে, তাতে তিনি এখন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। ফলে উনি দেশে ফেরার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করবে। সবাই চাইবেন তাঁর দেশে ফেরাকে স্মরণীয় ও স্মৃতিতে অমলিন রাখতে। তাঁকে স্বাগত জানাতে ছুটে যাবেন এমন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন দেশের লাখো মানুষ। আর বিএনপি নেতাকর্মীরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছেন।