এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : দেশের দক্ষিণ উপকূলে এখন ইলিশের মৌসুম। বছর দুয়েক আগেও এই সময় জেলেদের জালে উঠত ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের রুপালি ইলিশ। মাঝেমধ্যে ধরা পড়ত দেড় থেকে দুই কেজির ইলিশও। তবে সেই দৃশ্য এখন প্রায় উধাও। এ বছর জেলেদের জালে উঠছে মূলত জাটকা আর ছোট আকারের ইলিশ।
সড়কপথে পাচারের সময় উপকূলরক্ষী বাহিনীও নিয়মিত এসব ছোট ইলিশ জব্দ করছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ধরা পড়েছে কয়েক শ মণ জাটকা।
কিন্তু শুধু জাটকাই নয়, সঙ্গে সামান্য বড় ইলিশও মিলছে, যার ওজন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রামের আশপাশে।
জেলেদের ভাষায় সেগুলো নবীন ইলিশ। সদ্য ডিম ছাড়া, লম্বা আর পাতলা গড়নের এসব মাছের স্বাদও তেমন নেই। অনেক জেলের জাল একেবারেই ইলিশশূন্য ফিরছে।
জেলেরা বলছেন, গত এক দশকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী তাদের হতে হয়নি। তাদের জালে ধরা পড়া ইলিশ আকারে ছোট হলেও দাম কমেনি, উল্টো সংকটের কারণে বেড়েছে।
ইলিশের ঘাটতির সুযোগে বাড়ছে অন্য সামুদ্রিক মাছের চাহিদা। লাক্ষা, লইট্টা, মাইট্যা- সবগুলোর দামই এখন চড়া। শুধু সামুদ্রিক মাছ নয়, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চাষের মাছের দামও। তার ধাচে বেড়েছে পোল্টি মুরগির দাম।
জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞার পর গভীর সমুদ্রে গেলেও বড় ইলিশ মিলছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈরী আবহাওয়া। ফলে মৌসুমে ইলিশ আহরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বরগুনা ট্রলার মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় নিবন্ধিত জেলে প্রায় ৪৮ হাজার, সাগরে নামে সহস্রাধিক ট্রলার। এসব ট্রলারে কাজ করেন এক লাখ ২০ হাজার জেলে ও শ্রমিক। মা ইলিশ রক্ষার অভিযান শেষের আগে-পরের কয়েক মাস ধরে তাদের সবার মুখে এক কথা সাগরে ইলিশ নেই। টানা লঘুচাপ ও নিম্নচাপের কারণে সাগরের পানি অস্থির থাকায় লোকসানে পড়ছেন ট্রলার মালিকরা।
ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘এখন যে ইলিশ ধরা পড়ছে, তা ছোট, আর সংখ্যায়ও কম। প্রত্যেক ট্রলারই লোকসান করছে। এ অবস্থা কতদিন চলবে, বলা মুশকিল। মাছ না পড়ার পেছনে ট্রলিং ট্রলার দায়ী। এই ট্রলারের কারণে মাছ বিলীনের পথে।’
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সহকারী বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার জানান, মা ইলিশ রক্ষায় এ বছর ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত অবতরণ কেন্দ্রে উঠেছে ৯৯৭ মেট্রিক টন ইলিশ। গত বছর একই সময় ছিল এক হাজার ২০৪ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এ বছর প্রায় ২০৭ মেট্রিক টন কম, যা শতাংশ হিসেবে গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৮ ভাগ কম।
বিপ্লব কুমারের ভাষায়, ‘ইলিশ শুধু কমই নয়, আকারেও ছোট। নদীতে ডিম ছেড়ে সাগরমুখী নবীন ইলিশই এখন বেশি ধরা পড়ছে।’ সাগর থেকে আহরিত ছোট ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হয়েছে ২২ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকায়। নদীর ছোট ইলিশ কেজিপ্রতি দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রায় সব উপকূলেই একই চিত্র। বড় ইলিশ কমে যাওয়ার পেছনে নদী ও সাগরের দূষণ, পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি, বৃষ্টি কম হওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব মিলেই দায়ী। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, উপকূলজুড়ে চলতি বছর জুলাই-আগস্ট ইলিশ আহরণ করা হয়েছে ২৯ হাজার ৫১৯ মেট্রিক টন। গত বছর একই সময় আহরণ ছিল ৪০ হাজার ২৯১ টন। অর্থাৎ প্রায় ১১ হাজার টন বেশি।
বুধবার সকালেও বরগুনার পাথরঘাটায় ফিরেছে আট থেকে ১০টি ট্রলার। সাতটিতে ইলিশ মিলেছে, তবে সবই ছোট। কোথাও ২০০, কোথাও ৫০০টি। এফবি মায়ের দোয়া নামের একটি ট্রলার পেয়েছে প্রায় ৫০০টি ছোট ইলিশ। ট্রলারের জেলে শয়জদ্দিন মাঝি বলেন, ‘পাঁচ দিন সমুদ্রে জাল ফেলেছি। ইলিশ খুব কম পেয়েছি। গত বছর এই সময় দ্বিগুণ ধরেছি। নিষিদ্ধ ট্রলিং ট্রলারের কারণেই মাছ কমে গেছে।’
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর শুরুতে কিছু ইলিশ মিললেও এখন কমে গেছে, আকারও ছোট। দূষণ, বৃষ্টি কম হওয়া, অতিরিক্ত আহরণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মিলেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রাথমিক গবেষণায়। তিনি বলেন, বড় ইলিশ কেন কমে যাচ্ছে, তা জানতে আরো গভীর গবেষণা দরকার।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অনুষদের অধ্যাপক ড. রাজীব সরকারের মতে, বড় ইলিশ কমে যাওয়া এখন স্পষ্ট সংকেত। নদী সাগরের দূষণ, অক্সিজেনের ঘাটতি, কম বৃষ্টি ও জলবায়ুর প্রভাব ইলিশের বৃদ্ধি ও প্রাপ্যতাকে হুমকিতে ফেলছে। এতে জেলেদের জীবিকা সংকটে পড়ছে, বাজারে সরবরাহ কমে দাম বাড়ছে, ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে।
রাজীব সরকার মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, প্রজনন মৌসুমে কঠোর ব্যবস্থাপনা এবং ইলিশের আবাসস্থলে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ জরুরি।