বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৬:৪৬:২২

এতো কমে গেল ডিমের দাম!

এতো কমে গেল ডিমের দাম!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : এক বছরের বেশি সময় ধরে ডিম ও মুরগির মাংসের বাজারে টানা দর পতনে সংকটে পড়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প। প্রান্তিক খামারি থেকে শুরু করে ফিড মিল, ব্রিডার ফার্ম, ওষুধ ও বিপণন খাত– সবখানেই নেমে এসেছে স্থবিরতা। লোকসান সামাল দিতে না পেরে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কমছে উৎপাদন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পোলট্রি শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উৎপাদন খরচ বাড়ছে, দাম নামছে
ডিমের উৎপাদন খরচ বাড়লেও পাইকারি বাজারে দাম পড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে লেয়ার খামারিরা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিটি ডিমের দর নির্ধারণ করেছে খামার পর্যায়ে ১০.৫৮ টাকা, পাইকারিতে ১১.০১ টাকা ও খুচরায় ১১.৮৭ টাকা। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ১০.১৯ টাকা। অথচ বর্তমানে ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকায় খামার পর্যায়ে ডিম বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৭.৮৭ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে দাম কিছুটা বেশি হলেও সেটি ৮.৮০ থেকে ৯ টাকার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। সে হিসাবে প্রতিটি ডিম বিক্রি করে খামারির লোকসান হচ্ছে দুই থেকে ২.৩০ টাকা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডিমের দৈনিক উৎপাদন সাড়ে পাঁচ কোটি পিস। ফলে এক মাসেই খামারির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৪৮ কোটি টাকা।

ডিমের মতোই দর পতন হয়েছে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির বাজারে। সরকার নির্ধারিত হিসাবে খামার পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লারের দর ১৬৮.৯১ টাকা। অথচ বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২২ টাকায়। ফলে প্রতি কেজিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ৪৭ টাকা। সোনালি মুরগির ক্ষেত্রেও কেজিতে লোকসান ৫০ টাকার ওপরে।

লোকসান সামাল দিতে না পেরে অনেক খামারি নির্ধারিত সময়ের আগেই মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে একদিকে ক্ষতি বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদন চক্র ভেঙে পড়ছে। খামার পর্যায়ে ডিমের দাম সাত টাকা ৫০ পয়সায় নেমে এলেও খুচরা বাজারে একই ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯ থেকে ১০ টাকায়। অর্থাৎ একডজন ডিমে খামারি যেখানে ২০ থেকে ২৬ টাকা লোকসান গুনছেন, সেখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই ২০ থেকে ২৪ টাকা মুনাফা করছেন। একই চিত্র ব্রয়লার মুরগির বাজারেও। প্রতি কেজিতে খামারির লোকসান ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা, অথচ মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা ৪০ টাকার বেশি। পরিস্থিতি যাই হোক, লোকসানের বোঝা শুধু খামারির ঘাড়েই পড়ছে।
খামারির কান্না কেউ শোনে না

ফেনীর সোনাগাজীর সাতবাড়িয়া গ্রামের খামারি মো. ইকবাল হোসাইন সোহাগ বলেন, প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ৯ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৭.৫০ টাকায়। প্রতিদিন লোকসান ২২ হাজার টাকার বেশি। মাস শেষে তা দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ টাকা। তিনি বলেন, শীতকালে সাধারণত ডিমের দাম ভালো থাকে। তবে এ বছর উল্টো। সামনে রমজান আসছে, দাম আরও কমবে। এই ক্ষতি দেখার যেন কেউ নেই।

একই উপজেলার সাহেবের হাট এলাকার খামারি মো. নুরনবী জানান, খাদ্য ও ওষুধের দাম বাড়ছে, রোগবালাই লেগেই আছে। অথচ ডিমের দাম উৎপাদন খরচের অনেক নিচে। অনেক খামারি ইতোমধ্যে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরাও টিকে থাকার লড়াই করছি।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ডিম ও মুরগির দর পতনে পোলট্রি খাত কার্যত বিপর্যস্ত। পূর্ব গোবরিয়া গ্রামের খামারি শরিফ ও পশ্চিম গোবরিয়ার হাবিবুর রহমান প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সাড়ে ছয় হাজার লেয়ার মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন। এখন প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হচ্ছে। দুই মাসে লোকসান দাঁড়িয়েছে অন্তত সাত লাখ টাকা।

ডিম ও মুরগির দাম পড়ে যাওয়ায় খামারিরা নিয়মিত ফিড ও ওষুধ কিনতে পারছেন না। কুলিয়ারচরের পোলট্রি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আরশ মিয়া বলেন, অনেক খামারে খাদ্য সরবরাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে ফিড ও ওষুধ ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়ছেন।

সরকার ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা দর নির্ধারণ করলেও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করেনি। ফলে দাম বাড়লে বাজার তদারকি জোরদার হলেও দর পতনের সময় খামারির পক্ষে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বছরের বড় একটি সময় এই দর পতন চলতেই থাকে, পরে সরবরাহ সংকটে বাজার আবার অস্থির হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, আলু-পেঁয়াজের মতো ডিমও যদি সরকারিভাবে সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সারা বছর বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসি) পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিম ও মাংসের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ, অফ-সিজনে ভর্তুকি, কোল্ডস্টোরেজে ডিম সংরক্ষণের অনুমোদন, স্বল্পসুদে ঋণ এবং রপ্তানির ব্যবস্থা।

খামারিরা বলছেন, আমরা ন্যায্যমূল্য আর একটি স্থিতিশীল বাজার চাই। তা না হলে একের পর এক খামার বন্ধ হবে, কর্মসংস্থান হারাবে হাজারো মানুষ। 

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ডিম বা মাংসের দাম বাড়লে সরকারের সব তদারকি সংস্থা সক্রিয় হয়, কিন্তু দর পতনে কোনো সংস্থার পক্ষ থেকেই খামারির স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এভাবেই বছরের অধিকাংশ সময়ই ডিম ও মুরগির দর পতন ঘটছে।

তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে এ পরিস্থিতি সামাল দিতে অফ-সিজনে খামারিদের ভর্তুকি দেওয়া হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত ডিম সংরক্ষণে কেল্ডস্টোরেজে ব্যবস্থাও করা হয়। আমাদের দেশে এসবের কিছু নেই।  

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ডিম-মুরগির দাম বছরে মাঝে মাঝে ওঠানামা করে। এখন সবজির প্রাপ্যতা বেশি হওয়ার কারণে ডিমের চাহিদা কমেছে। আবার শীতকালে স্কুলগুলো বন্ধ। হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও ডিমের চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া অন্য বছরের চেয়ে এবার শীতে সামাজিক অনুষ্ঠানের সংখ্যাও কম। ফলে চাহিদা না থাকায় ডিম-মুরগির দাম কিছুটা কম।

তিনি বলেন, খামারির সুরক্ষায় আমরা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছি। এ বছর আমরা আমদানির অনুমতি দেইনি। খামারিদের উৎপাদন খরচ কমাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে