বুধবার, ০৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০:৪৬

রামপুরা দুই শিশু হত্যা : মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে অঝোরে কাঁদলেন স্বামী-স্ত্রী

রামপুরা দুই শিশু হত্যা : মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে অঝোরে কাঁদলেন স্বামী-স্ত্রী

ঢাকা : স্বামীকে সামনে পেয়ে অঝোরে কাঁদলেন দুই সন্তানের ঘাতক মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি নিহত দুই শিশু অরনী ও আলভীর বাবা আমানউল্লাহও। তিনিও কাঁদতে থাকেন।

রামপুরা থানার মহিলা হাজতখানার লোহার শিক ধরে দু’জনে প্রায় ১৫ মিনিট অঝোরে কাঁদেন। এ সময় থানায় এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ আমানউল্লাহকে ওসির কক্ষে নিয়ে আসে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সেখানে আনা হয় জেসমিনকে। পুলিশ আমানউল্লাহর সামনে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রামপুরা থানায় আসেন আমানউল্লাহ ও তার বৃদ্ধা মা হাসনা বেগম। জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এর আগে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় দুই সন্তানকে হত্যায় অভিযুক্ত জেসমিন সাবলিলভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

তবে মঙ্গলবার স্বামী ও শাশুড়ির সামনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরে তিনি চুপ থাকেন। এভাবে বেশকিছু সময় পার হওয়ার পর অরনী ও আলভীকে হত্যার সঙ্গে তার স্বামী (আমানউল্লা) জড়িত আছেন কিনা- পুলিশের এক কর্মকর্তা এমন প্রশ্ন করতেই মুখ খোলেন জেসমিন।

জবাবে তিনি বলেন, ‘কতবার বলেছি, ও কিছুই জানে না। আমি একাই খুন করেছি। আমাকে ফাঁসি দিন।’ একথা বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন জেসমিন।

রামপুরা থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর জেসমিন আবার বলতে থাকেন, ‘আমি আর পারছি না। আমাকে আদালতে হাজির করেন, আমি আদালতকেও একই কথা বলব।’

এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় স্বামীর বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ আছে কিনা। জবাবে জেসমিন বলেন, ‘না- ও খুব ভালো মানুষ, ওর কোনো দোষ নেই। পরে ওই কক্ষে আনা হয় ঘটনার দিন বাসায় থাকা জেসমিনের শাশুড়ি (নিহত দুই শিশুর দাদি) হাসনা বেগমকে।

জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা বলেন, শাশুড়িকে সামনে আনার পর জেসমিন মাথা নিচু করে রাখেন। এর পর তিনি আর কোনো কথা বলেননি। পরে পুলিশ হাসনা বেগমের সঙ্গে কথা বলেন। হাসনা বেগম সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ৫ তলার ওই ফ্ল্যাটে তিনি যে রুমে থাকতেন সে রুম থেকে বৌমাদের (জেসমিন) শোবার ঘরের দূরত্ব বেশ অনেকটা। স্বাভাবিক কথাবার্তা শোনা যায় না।

পুলিশকে তিনি বলেন, ঘটনার দিন আছরের নামাজ আদায় শেষে তিনি নিজের রুম থেকে বাইরে আসতেই একটা গোঙানির আওয়াজ পান। এ সময় তিনি ওই ঘরের দরজায় নাড়া দিয়ে কয়েকবার বৌমাকে ডাকেন। সাড়া না পেয়ে তিনি কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসে থাকেন। ১৫-২০ মিনিট পর তার বৌমা হঠাৎ দরজা খুলে বাইরে এসে বলে, ‘দেখেন আম্মা ওরা (অরনী ও আলভী) কেমন জানি করছে। এর পর তিনি ওই ঘরে গিয়ে দু’জনকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।

ঘটনার আগে ওই বাসায় তিনি কাউকে আসতে-যেতে দেখেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমুতে যাওয়ার আগে তিনি অরনীর ম্যাডামকে দেখেছেন। প্রতিদিন দুপুরে অরনীকে পড়াতে ওই ম্যাডাম বাসায় আসতেন। স্বামী ও শাশুড়ির সামনে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর জেসমিনকে ফের নিয়ে যাওয়া হয় হাজতখানায়।

রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, আজ (বুধবার) মহফুজা মালেক জেসমিনকে আদালতে হাজির করা হবে। তিনি নিজে থেকেই আদালতে দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়েছেন। তবে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পুলিশের জানা হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি আদালতে প্রমাণের জন্য আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।

ওসি বলেন. এখন পর্যন্ত শিশু দুটির মা জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রমাণ করার মতো তেমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। গত ৫ দিনে সাবলিলভাবে তিনি পুলিশকে জানান একাই দু’সন্তানকে খুন করেন তিনি। মঝে মধ্যে কথাবার্তায় তাকে মানসিক ভারসম্যহীন বলেও মনে হয়েছে। বিশেষ করে জেসমিনের মা জুলেখা বেগম মানসিক রোগী বলে তারা জানতে পেরেছেন। বড় সন্তান হিসেবে পারিবারিকভাবে জেসমিনও মায়ের রোগ পেতে পারেন বলে ধারণা করছেন তারা। তবে এটি প্রমাণ করতে হলে জেসমিনকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে পুলিশের একটি টিমকে জামালপুরে জেসমিনের মায়ের বাসায় পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

ওসি রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, মামলাটি তদন্তের জন্য ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে ন্যস্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতে হাজিরার পর গোয়েন্দা পুলিশ তাদের প্রয়োজনে নতুন করে রিমান্ডের আবেদন জানাতে পারে। এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত তারা আদালতের মাধ্যমে নতুন তদন্ত সংস্থার কাছে হস্তান্তর করবেন বলেও জানান তিনি। সে হিসেবে চাঞ্চল্যকর দুই শিশু হত্যার তদন্তভার আজ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ন্যস্ত হচ্ছে।

২৯ ফেব্রুয়ারি বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির ৫ম তলার ভাড়া বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় স্বজনরা অরনী ও আলভীকে উদ্ধার করে প্রথমে আল রাজী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাত ৮টার দিকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ওই দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এমনকি এ দাবি করে ময়নাতদন্ত করতেও বাধা দেন ওই দুই শিশুর বাবা-মা। তবে মা-বাবার রহস্যজনক আচরণের কারণে পুলিশ ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। পরে পুলিশের চাপাচাপিতে ময়নাতদন্ত করা হয়। এরপরই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।

ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক বলেন, বিষক্রিয়া নয়, শ্বাসরোধে শিশু দুটিকে হত্যা করা হয়েছে। লাশের শরীরে আঘাত এবং আঁচড়ের অসংখ্য চিহ্ন রয়েছে। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে।

এদিকে এর আগেই মর্গে না গিয়ে জামালপুর গ্রামের বাড়ি চলে যান জেসমিন ও আমান। পরে র‌্যাব তাদের আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে। বৃহস্পতিবার রাতে দুই শিশুর বাবা আমানউল্লাহ বাদী হয়ে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে তিনি তার স্ত্রী মাহফুজা মালেক জেসমিনকে একমাত্র আসামি করেন।

শুক্রবার জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তীর আদালতে হাজির করে রামপুরা থানা পুলিশ। আদালত দুই পক্ষের শুনানি শেষে পাঁচদিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওই রিমান্ড মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। -যুগান্তর ডেস্ক
৯ মার্চ, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে