বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬, ০৩:০০:১২

চাপের মুখেই রাখাল বালকের বিদায়

চাপের মুখেই রাখাল বালকের বিদায়

পীর হাবিবুর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান অশ্রুসজল নয়নে পদত্যাগ করে অবশেষে বিদায় নিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় যারা তার কথা শুনছিলেন তারা উপলব্ধি করেছেন তিনি বাকরুদ্ধ হচ্ছিলেন। আবেগাপ্লুত হচ্ছিলেন। বুক ভরা কান্না চোখ জুড়ে খেলা করছিলো। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার চার মাস আগে টাকা চুরি নিয়ে তুমুল বিতর্কের মুখে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।

টাকা চুরির ঘটনা অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রায় ১ মাস  গোপন রাখা এবং এরকম পরিস্থিতিতে দেশবাসীর সামনে সবকিছু খোলাসা না করেই দিল্লিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলে যাওয়ায় সরকারের ওপর মহল অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত গতকাল পদত্যাগ করেই বিদায় নিতে হয়েছে বিয়োগান্তুক ভাবে।  
সোমবার অপরাহ্ণেই তার বিদায় পর্বটি গণমাধ্যমের সামনে পুরস্কার হয়ে ওঠে। সেদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রিজার্ভের টাকা চুরির এতবড় ঘটনা গোপন রাখা সহ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দিল্লি চলে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সহ সিনিয়র মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে বৈঠক করেন  সেখানে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে ড. আতিউরকে হয় পদত্যাগ না হয় অব্যাহতির সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।  

যদিও গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগ করে গুলশানের বাসভবনে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন নৈতিক দায়িত্ব থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন, কোনো চাপ ছিল না। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায় রাখাল বালকের নায়কোচিত ইমেজ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হলেও গতকাল চাপের মুখেই তাকে বিয়োগান্তুক ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে বিদায় নিতে হয়েছে। দিল্লি থেকে সোমবার বিকালে ঢাকায় নেমেই তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়েছিল। সেখানে অর্থমন্ত্রী, সচিব সহ কর্মকর্তারা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তিনি সচিবালয়ে যাননি। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে গেলে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়।

দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে সন্ধ্যায় তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন তার সঙ্গে। তিনি অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি গোপন রাখার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। কিন্তু ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী তা শুনতে রাজি হননি। বলেছেন, আপনি পদত্যাগ করুন। ড. আতিউর রহমান অর্থমন্ত্রীর কথায় পদত্যাগে অনীহা প্রকাশ করে বলেন ‘প্রধানমন্ত্রী বললেই কেবল তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তাকে জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী বলবেন না কিন্তু আপনি পদত্যাগ করবেন।

সেখান থেকেই ড. আতিউর রহমান ছুটে যান গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না  পেয়ে চলে আসেন গুলশানের বাসভবনে। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছুটে যান পদত্যাগপত্র হাতে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ফিরে এসে বেলা ৩টায় গুলশানের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাই তার কাছেই পদত্যাগ করেছেন। তিনি অর্থমন্ত্রীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান।

বলেন- প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য কাজ করেছেন। পদত্যাগপত্র পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। বলেছেন- আপনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আমাদের ২৮ বিলিয়ন রিজার্ভ দিয়েছেন। বাংলাদেশের টাকাকে শক্তিশালী করেছেন। ড. আতিউরের ভাষায় এরচেয়ে আর কিছু পাওয়ার নেই আমার। এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন- বাংলাদেশ ব্যাংককে আমি সন্তানের মতো দেখেছি। ২৮ বিলিয়ন ডলার গড়েছি। সেটা হারিয়ে যাবে- এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। আমি খোলা বইয়ের মতো।

এদেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে কাজ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য পরিশ্রম করেছি। তিনি চান না তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যায় পড়ুক। যারা এই চুরির সঙ্গে জড়িত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তিনি পদত্যাগের পর জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বলেছেন- এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। যা সৎ সাহসী নৈতিক মনোবলের বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বিদায়ী গভর্নরের পদত্যাগপত্র গ্রহণের কথা জানিয়ে এই বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।

২৯শে ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের  ডেইলি ইনকুয়ারারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জনগণের অর্থ চুরির খবর প্রকাশিত হলে এ  দেশের গণমাধ্যমে ঝড় ওঠে। বিষয়টি গোপন করার রহস্য নিয়ে সরকারের ভেতরে বাইরে দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।  বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন এটিএম বুথ কেলেংকারির পর রিজার্ভের টাকা চুরি হওয়ায় তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। এটি উদ্ধার প্রটেকশন সব মিলিয়ে উপর মহলকে জানাতে বিলম্ব করেন। তার সততা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও তার এই বক্তব্য পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

এমনকি আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এককালের কমিউনিস্ট নূহ-উল আলম লেনিন ড. আতিউরকে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চেলা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন, ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যস্ত থাকার অভিযোগ এনে  যে বিষোদগার করেছেন তাতে প্রধানমন্ত্রী যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছেন তেমনি পর্যবেক্ষকমহল বিস্মিত হয়েছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন ভাষার কি মাধুর্য! যেন ড. ইউনূসের সুপারিশে তাকে গভর্নর নিয়োগ  দেয়া হয়েছিল! তবুও ভালো সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে এই  কেলেঙ্কারির ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করেননি।

পর্যবেক্ষকদের ভাষায় আমাদের অর্থমন্ত্রী ভাষাসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত, একুশের বইমেলায় হেঁটে বেড়ানো একজন সৃজনশীল লেখকও। তেমনি রাখাল বালক খ্যাত বিদায়ী গভর্নর ড. আতিউর রহমান কৃষকের বন্ধু, সেমিনারের মধ্যমণি ও রবীন্দ্র গবেষক। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাত সহ পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে কতোটা দক্ষ নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন সেটির পোস্টমর্টেম হওয়ার সময় এসেছে। ব্যাংকের টাকা চুরি, শেয়ার বাজার  কেলেংকারি, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে লুটপাট মানুষের আস্থার জায়গাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাংকে টাকা চুরির ঘটনা গোপন রেখে সুখ নিদ্রায় যাওয়া ব্যর্থতার দায় নিয়ে।

অবশ্যই ব্যর্থতার দায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের এই বিদায় যৌক্তিক। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। জনগণের এই সম্পদ হেফাজতকারী সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পদের পাহারাদার মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিই ছিল না, কথা-বার্তাও বন্ধ ছিল।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়হীনতার চরমে রেখে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর স্বাভাবিক গতিতে সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা কতটুকু সম্ভব ছিল। শেয়ার বাজার রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ৩২ লাখ বিনিয়োগকারীর অশ্রু ও তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে অভিশপ্ত হয়েছে। না অর্থ মন্ত্রণালয় সেটিকে জাগাতে ভূমিকা  রেখেছে, না বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রেখেছে। শেয়ার বাজার চাঙা করার ক্ষেত্রে কোন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ছিলেন বাধা। শেয়ার  কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে সরকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থায় যেতে পারেনি সরকার।

সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ৪ হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠন হয়ে গেছে। সেই টাকার তুলনায় এফবিসিসিআই প্রেিিসডেন্ট মতলুব আহমেদ যখন রিজার্ভ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা কোন বিষয় না বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে সমালোচনার নৈতিক জায়গা দুর্বল হয়ে পরে। রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা স্বীকার করা ছাড়া অর্থমন্ত্রী কিইবা করেছেন?

প্রশ্ন উঠেছে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও গতিতে দক্ষতায় প্রশংসিত, দেশ যখন অর্থনীতিতে এগিয়েছে, ঠিক তখন শুধু সততার তকমা নেয়া অদক্ষ লোক তার টিমে কতটা গ্রুহণযোগ্য। রিজার্ভ ব্যাংকের ৮শ কোটি টাকা ফিরে পাওয়া যাবে কিনা সেই প্রশ্নের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, শুভঙ্করের ফাঁকির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্থ সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে কার্যকর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। দেশের পুঁজিবাজার চাঙ্গাই নয়, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দুর্নীতি ও অনিয়মকে হটিয়ে ব্যাংকিং সেবা খাতকে ব্যবসা ও অর্থ বান্ধব করে তোলা বড় বিষয়। আমাদের রিজার্ভসহ মানুষের অর্থের পাহারা নিরাপদ রাখা।

এতোসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাখাল বালক গভর্নর আতিউরের বিদায়েই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা নয়, টোটাল সিস্টেমে দক্ষ ও সৎ, কার্যকর নেতৃত্বের ব্যবস্থাপনায় মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করে হতাশার কবল থেকে তুলে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ।
তাই রাখাল বালকের বিদায়ই শেষ কথা নয়, বাকি সহজ কথাগুলোকেও সহজ ভাবে নেয়াই সরকারের জন্য বড় বিষয়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম
সূত্র : মানবজমিন

১৬ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে