বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬, ০২:১৪:৪৯

রিজার্ভ চুরি : ১০ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে কমিটি

রিজার্ভ চুরি : ১০ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে কমিটি

মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ : ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে ১০টি ইস্যুকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে তদন্ত কমিটি। ঘটনা তদন্তে প্রয়োজনে ফিলিপাইন এবং যুক্তরাষ্ট্রেও যাবেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। শুধু তাই নয়, তথ্যগত সহায়তার জন্য এ ঘটনার তদন্তকারী অন্য সংস্থা সিআইডি এবং এফবিআই প্রতিনিধির সঙ্গেও কথা বলবেন ড. ফরাসউদ্দিন।

কেননা ঘটনার আলামত এ দুটি সংস্থার কাছেই রয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর ফজলে কবিরসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. ফরাসউদ্দিন। বৈঠকে তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কায়কোবাদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাসও উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে ১০টি ইস্যুকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তদন্ত কাজে। এগুলোকে প্রশ্ন আকারে সাজিয়ে তদন্ত কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এগুলো হলো— ডিলিং রুমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কিনা। প্রিন্টার কেউ নষ্ট করেছিল নাকি প্রিন্টারের সিস্টেম ফল্ট করেছিল। এ ঘটনায় ডিলিং রুম ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের কারও কোনো অবহেলা ছিল কিনা। তারা কেউ আগে থেকে জানত কিনা।

ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিলম্ব করা হয়েছিল কিনা। একই সময়ে দুই দেশের সিসি টিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল কী কারণে। সর্বশেষ কবে সেগুলো সচল ছিল সে প্রশ্নের উত্তরও খুঁজবে তদন্ত কমিটি। সুইফট কোড চুরির যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটা কীভাবে সম্ভব হলো। কোন পদ্ধতিতে চুরি হলো সেটাও অনুসন্ধান করা হবে।

সার্ভার হ্যাক হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেন টের পেলেন না বা ফেডারেল রিজার্ভ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা। এমনকি ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কোনো কর্মকর্তার সরাসরি সংশ্লিষ্ট আছে কিনা তাও অনুসন্ধান করা হবে। হ্যাকারদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ ছিল কিনা-থাকলে সেটা সুপারভিশনে ধরা পড়ল না কেন এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্ত কমিটির সামনে।

ডিলিং রুমের কম্পিউটারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য শাখা/বিভাগের কম্পিউটারের সরাসরি সংযোগ ছিল কিনা। থাকলে সেটা কেন ছিল। তা ঝুঁকিপূর্ণ কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ক্ষতিকারক ভাইরাস বা সফটওয়্যার ম্যালওয়্যার বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার বা কম্পিউটারে প্রবেশের আগে বোঝার কোনো উপায় ছিল কিনা। এক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তা দায়িত্বে অবহেলা করেছে কিনা। এক্ষেত্রে রাকেশ আস্তানার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকের কর্মকর্তারা না জেনেই ওই সফটওয়্যার কপি করে ফেলেছেন। সে কথা কতটা যৌক্তিক তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সর্বোপরি দায়িত্বে অবহেলা বা নিরাপত্তা দিতে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এ অভিযোগে গভর্নরসহ যাদের ইতিমধ্যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের কারও কোনো অবহেলা ছিল কিনা-বা এ ঘটনার সঙ্গে কারও কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা-তাও খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি। সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফাইনাল পেমেন্ট অর্ডার যাওয়ার আগেই লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে সেটা কেন হলো। এতে রিজাল ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবহেলা বা অন্য কোনো ইন্টারেস্ট ছিল কিনা।

ফেঁসে যাচ্ছেন ফিলিপাইনের দুই সুন্দরী : বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার পাচারে ফেঁসে যাচ্ছেন ফিলিপাইনের দুই সুন্দরী কর্মকর্তা। ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইতিমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিট শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দিগুইতোর বিরুদ্ধে। ফিলিপাইন থেকে হংকংয়ে টাকা পাচারের মাধ্যম রেমিট্যান্স কোম্পানি ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট স্লুড বাতিস্তাও ফেঁসে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে অবৈধ রেমিট্যান্স লেনদেনের অভিযোগ তদন্ত করছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর আগে সাময়িক বরখাস্ত হলেও গতকাল দিগুইতোকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ঘটনার পর দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে ম্যানিলার বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। পরে কর্তৃপক্ষ তার দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন তিনি মাকাতি সিটিতে পুলিশি নজরদারিতে আছেন। এদিকে গতকাল ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করেছে।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, দিগুইতো ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার স্ট্রিট শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন ২০১৪ সালে। তিনি এর আগে দেশটির ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকে চাকরি করতেন। জুপিটার স্ট্রিট শাখায় যোগ দেওয়ার পরই তিনি অর্থ হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনায় যুক্ত হন। সে অনুযায়ী গত বছর মার্চে চারজন ব্যক্তিকে দিয়ে চারটি অ্যাকাউন্ট খোলেন ওই শাখায়। চার অ্যাকাউন্টধারী নিজেদের ঠিকানা ব্যবহার করেন মাকাতি সিটির একটি এলাকা। তথ্যপ্রমাণ হিসেবে নিজেদের ড্রাইভার লাইসেন্সের কপিও জমা দেন। চার হ্যাকার অ্যাকাউন্টধারী হলো মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগোরাস, আলফ্রেড ভারগারা এবং এনরিকো তায়েদ্রো ভাসকুয়েজ।

এরপর এই চারজনের সঙ্গে চীনের নাগরিক ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইসার কোম্পানির মালিক কিম অং-কে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের জন্য কাজ করেন। প্রায় এক বছর ধরে হ্যাকিংয়ের এই কার্যক্রম চলে। অবশেষে তারা সফল হন। পরে কিম অংয়ের নামেও আরেকটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ঘটনা তদন্তের পর দেখা যায়, পাঁচটি অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেই গ্রাহকের নো ইউর কাস্টমার (কেওয়াইসি) তথ্য পূরণ না করে ব্যাংক শাখা অ্যাকাউন্ট খোলে। এমনকি যে ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাসস্থানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি ভুয়া।

চারটি অ্যাকাউন্টে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ৮১ মিলিয়ন ডলার জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অ্যাকাউন্ট জব্দ করার অনুরোধ পাঠায়। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি শাখা ব্যবস্থাপক এ অনুরোধ পাওয়ার পরেও চার অ্যাকাউন্টে অর্থ পরিশোধ করে দেন। এর মধ্যে ক্রিস্টোফার লাগরোসাস ৩০ মিলিয়ন, আলফ্রেড ভারগারা ১৯.৯৯ মিলিয়ন, এনরিকো ভাসকুয়েজ ২৫ মিলিয়ন ও মাইকেল ক্রুজের ৬ মিলিয়ন ডলার। যা দুটি ক্যাসিনোতে চলে যায়।

লাগরোসাসের আলাদা ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট করে সেখানে ২২ মিলিয়ন ডলার জমা করেন এবং গার্মেন্ট ব্যবসায়ী উইলিয়াম সোগো নামে একজনের অ্যাকাউন্টে দুটি অর্ডারের মাধ্যমে ১৪.৭ মিলিয়ন ডলার জমা হয়। সোগোর অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে চেকের মাধ্যমে দিগুইতো সব অর্থ উত্তোলন করে নিজের গাড়িতে নিয়ে যান। ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা লরেঞ্জো টোরেসের সহযোগিতায় তিনি এ অর্থ উত্তোলন করেন। আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ গতকাল দুই কর্মকর্তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে।

দিগুইতোর উত্তোলন করা অর্থ রেমিট্যান্স লেনদেন কোম্পানি ফিলরিমের মাধ্যমে কিম অং নামে হংকংয়ে এক ব্যক্তির কাছে চলে যায়। ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধ পরিপালন করে অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়। তবে সো গোর অ্যাকাউন্টে মাত্র ৬৮ হাজার ডলার ছিল। বাকি সব অর্থ আগেই লোপাট হয়ে যায়।

ফিলিপাইনে এএমএলসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো রিজার্ভ হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ নিয়ে আসার বিষয়টি শুরু থেকেই জানতেন। ডলার জমা হলে তড়িঘড়ি তা ট্রান্সফার করা হয়। কোনো প্রমাণ যেন না থাকে, সেজন্য লেনদেন সম্পন্ন করতে ওইদিন ব্যাংক শাখার সব সিসি ক্যামেরা তিনি বন্ধ করে রাখেন। অর্থ পাওয়ার পর ক্যাসিনো মালিক কিম অং তা হংকংয়ে উইক্যাং জু নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঠান।

ক্যাসিনোর একজন অপারেটর উইক্যাং জু চীনের নাগরিক। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে গ্রেফতার করতে হন্যে হয়ে খুঁজছে ফিলিপাইনের পুলিশ। দিগুইতোর বিরুদ্ধে গত ১১ মার্চ এএমএলসি মানি লন্ডারিং আইনে একটি এবং ব্যবসায়ী সো গো ২০ মার্চ নিজের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে জালিয়াতি, ঘুষ প্রস্তাবের অভিযোগ দিয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন।

ফিলিপাইনের রেমিট্যান্স লেনদেন কোম্পানি ফিলরিমের মাধ্যমেই পুরো অর্থ পাচার হয় হংকংয়ে। প্রতিষ্ঠানটি কোনো তথ্যপ্রমাণ না রেখে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ট্রান্সফার করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট স্লুড বাতিস্তা ঘটনায় নিজের সম্পৃক্তার কথা অস্বীকার করে সিনেট কমিটির সামনে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে অপরিচিত ব্যক্তিকে কীভাবে তিনি অর্থ দিলেন তার কোনো উত্তর দিতে পারেননি। বাতিস্তা গত ১৫ মার্চ সিনেট কমিটি শুনানিতে বক্তব্য দেন।

ফিলরিম জড়িত রয়েছে বলে তাদের সব কাজগপত্র চেয়ে পাঠায় সিনেট। একই সঙ্গে আপাতত ফিলরিমের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিনেট কমিটি বাতিস্তার কাছে জানতে চান, ‘এই মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন কোনো ধরনের তথ্য না নিয়ে করা হলো কেন? এটি কোনোভাবেই বিশ্বাস যোগ্য নয়।’ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বাতিস্তা বাংলাদেশকে ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ফেরত দিতে চেয়েছেন। বাংলাদেশ তা নিতে অস্বীকার করেছে। বাতিস্তাও এখন পুলিশি নজরদারিতে।

রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় এএমএলসি গতকাল আরও একটি মামলা দায়ের করেছে। ক্যাসিনো মালিক কিম অং ও অপারেটর উইক্যাং জুকে আসামি করে আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে ৯ পৃষ্ঠার অভিযোগে বলা হয়েছে, সিনেট কমিটির শুনানিতে প্রমাণ পাওয়া গেছে ক্যাসিনো অপারেটর উইক্যাং জু ৩০.৫ মিলিয়ন ডলার নিয়েছেন গত ৫ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি কিম অং নিয়েছেন ২১.৬ মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ তারা পরে হংকংয়ে পাচার করে দিয়েছেন। -বিডি প্রতিদিন
 
২৩ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে